নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস: নিউজিল্যান্ডের ৮০ শতাংশ অংশ জনশূন্য কেন? জানুন এর কারণ

নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস: নিউজিল্যান্ডের ৮০ শতাংশ অংশ জনশূন্য কেন? জানুন এর কারণ

প্রশান্ত মহাসাগরের (Pacific Ocean) দক্ষিণে অবস্থিত নিউজিল্যান্ড তার অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং উচ্চ জীবনমানের জন্য বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধ।

এটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক শান্তিপূর্ণ দেশ (Second Most Peaceful Country In The World) এবং ভারত-পাকিস্তানে মূলত ক্রিকেটের কারণে পরিচিত। এর উঁচু পাহাড়, সবুজ উপত্যকা এবং জৈব খাদ্য এটিকে একটি অনন্য পরিচয় দেয়। এমনকি বিখ্যাত হলিউড চলচ্চিত্র “লর্ড অফ দ্য রিংস”-এর শুটিংও নিউজিল্যান্ডে হয়েছিল।

তবে, এত চমৎকার আবহাওয়া, কম অপরাধের হার এবং উন্নত জীবনযাত্রার পরেও নিউজিল্যান্ডের ৮০% অংশ জনশূন্য। বেশিরভাগ জনসংখ্যা উত্তর দ্বীপে বসবাস করে, যার মধ্যে ৫০% এরও বেশি মানুষ শুধুমাত্র অকল্যান্ডে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত চমৎকার একটি দেশের বেশিরভাগ অংশ ফাঁকা কেন? এই প্রশ্নটি নিউজিল্যান্ডের ভূগোল এবং জনসংখ্যা কাঠামোর একটি রহস্য হয়ে ওঠে।

এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস এবং ভূগোলের গভীরে যেতে হবে।


নিউজিল্যান্ড কোথায় অবস্থিত? (Where is New Zealand Located?)

নিউজিল্যান্ড দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে (South-West Pacific Ocean) অবস্থিত একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। এটি দুটি প্রধান দ্বীপ, উত্তর দ্বীপ (North Island) এবং দক্ষিণ দ্বীপ (South Island), এবং বেশ কিছু ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত। নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার (Australia) দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ২,০০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত, যা তাসমান সাগর (Tasman Sea) দ্বারা বিভক্ত। এর নিকটতম প্রতিবেশী দেশ হলো নিউ ক্যালেডোনিয়া, ফিজি এবং টোঙ্গা (New Caledonia, Fiji, Tonga)

নিউজিল্যান্ডের ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা করে রেখেছে, যার ফলে এটি তার অনন্য জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত।


নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস (History Of New Zealand)

নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস শুরু হয় ১৩শ শতাব্দীতে, যখন মাওরি (Maori) জাতিগোষ্ঠী এই দ্বীপ আবিষ্কার করে। মাওরি জনগণ পলিনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে বিশাল নৌকায় করে এই অজানা ভূমিতে আসে। তবে কিছু ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, নিউজিল্যান্ডের আবিষ্কার ৫০০ বছর আগেই, ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে কুপে (Kupe) নামক এক মাওরি জেলে করেছিলেন। কুপে তার গোত্রের সঙ্গে সমুদ্রে খাদ্যের সন্ধানে বের হয়, কারণ তাদের অঞ্চলের অক্টোপাস মাছ খেয়ে ফেলছিল।

এই অভিযানের সময়, কুপে এবং তার সঙ্গীরা একটি বিশাল, সবুজে ঘেরা এবং সম্পদে সমৃদ্ধ দ্বীপ খুঁজে পায়—এটিই ছিল নিউজিল্যান্ড। কুপে তার সম্প্রদায়কে এই নতুন স্থান সম্পর্কে জানায়, এবং এরপর থেকে মাওরি জনগণ সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করে।


মাওরি জাতিগোষ্ঠী ও ইউরোপীয়দের আগমন (Maori Tribe and European Arrival)

প্রায় ৪০০ বছর ধরে মাওরি জনগণ শান্তিতে এই দ্বীপে বসবাস করছিল। তবে ১৭শ শতাব্দীতে, ইউরোপীয় দেশগুলো নতুন অঞ্চল খোঁজার ও দখল করার নীতি গ্রহণ করে।

১৬৪২ সালে ডাচ অভিযাত্রী আবেল তাসমান (Abel Tasman) নিউজিল্যান্ড আবিষ্কার করেন, কিন্তু মাওরি জনগণের সাথে সংঘর্ষের কারণে তাকে ফিরে যেতে হয়। প্রায় ১২৭ বছর পর, ১৭৬৯ সালে ব্রিটিশ নাবিক ক্যাপ্টেন জেমস কুক (James Cook) নিউজিল্যান্ডে আসেন

প্রথমে মাওরি ও ইউরোপীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, কিন্তু পরে ব্রিটিশরা নতুন কৌশল নেয়—তারা বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রলোভন দেখিয়ে মাওরিদের সঙ্গে চুক্তি করে। ধীরে ধীরে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা এখানে স্থায়ী হতে শুরু করে এবং ১৮শ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্রিটিশদের দখলদারিত্ব শক্তিশালী হয়ে ওঠে


ব্রিটিশ উপনিবেশ ও মাওরি সংঘাত (British Colonization and Maori Struggle)

১৮৪০ সালে, ব্রিটিশদের সঙ্গে মাওরি নেতাদের মধ্যে “ওয়াইটাঙ্গি চুক্তি” (Treaty of Waitangi) স্বাক্ষরিত হয়, যা নিউজিল্যান্ডকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ করে দেয়।

সে সময় মাওরি জনগণের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ, কিন্তু পরবর্তী ১০০ বছরে এটি কমে মাত্র ৪০,০০০-এ নেমে আসে। এর পেছনে দুটি মূল কারণ ছিল—

  1. নতুন রোগবালাই: ইউরোপীয়দের মাধ্যমে নতুন রোগ আসায়, যেগুলোর বিরুদ্ধে মাওরিদের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল না, তাদের সংখ্যা কমতে থাকে।
  2. সংঘর্ষ ও যুদ্ধ: ওয়াইটাঙ্গি চুক্তির কয়েক বছর পর, ব্রিটিশ সরকার ও মাওরিদের মধ্যে ভূমির মালিকানা নিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়, যা প্রায় ৪০ বছর ধরে চলে

১৮৮১ সালে, ব্রিটিশ বাহিনী মাওরিদের বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে দমন করে। এরপর থেকে নিউজিল্যান্ডে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের যুগ শুরু হয়।


নিউজিল্যান্ডের ৮০% অংশ জনশূন্য কেন?

নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যার ৭০% অংশ শুধু উত্তর দ্বীপে (North Island) বসবাস করে এবং তার মধ্যে ৫০% এরও বেশি মানুষ অকল্যান্ডে থাকে

এর প্রধান কারণগুলো হলো—

  • কঠোর জলবায়ু ও দুর্গম এলাকা: নিউজিল্যান্ডের অনেক অঞ্চল পার্বত্য ও দুর্গম, যেখানে বসবাস করা কঠিন।
  • সীমিত অর্থনৈতিক সুযোগ: শিল্প ও বাণিজ্য প্রধানত উত্তর দ্বীপেই কেন্দ্রীভূত, ফলে মানুষ দক্ষিণ দ্বীপে স্থায়ী হতে চায় না।
  • ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা: নিউজিল্যান্ডের অবস্থান বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, যা এর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে কমিয়ে দিয়েছে।
  • পরিবেশ সংরক্ষণ: নিউজিল্যান্ড সরকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ করে, ফলে জনবসতি বিস্তার সীমিত।

অকল্যান্ডে হাউজিং সংকট ও সরকারি উদ্যোগ

অকল্যান্ড বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল শহর হয়ে উঠেছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য নিউজিল্যান্ড সরকার অকল্যান্ডের বাইরে বসতি স্থাপনের জন্য ৮,০০০ ডলার অনুদান দিচ্ছে।


নিউজিল্যান্ডের অর্থনীতি ও কৃষিখাত (New Zealand Economy And Agriculture)

নিউজিল্যান্ডের অর্থনীতি মূলত কৃষি, পশুপালন ও রপ্তানির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

  • নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ, কিন্তু সেখানে ভেড়া ও গবাদি পশুর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি
  • ডেইরি শিল্প (Dairy Industry) দেশটির GDP-র প্রায় ৫% অবদান রাখে
  • নিউজিল্যান্ড বিশ্বের সর্বাধিক মেষের মাংস ও উলের রপ্তানিকারক দেশ

নিউজিল্যান্ডের পর্যটন শিল্প (Tourism Industry)

নিউজিল্যান্ডের পর্যটন শিল্প এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য বিশ্ববিখ্যাত

  • কুইন্সটাউন (Queenstown) বাঞ্জি জাম্পিং, স্কাইডাইভিং ও রাফটিং-এর জন্য পরিচিত।
  • মিলফোর্ড সাউন্ড, মাউন্ট কুক ও রোটোরুয়া ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণ করে।
  • “লর্ড অফ দ্য রিংস”-এর শুটিং হওয়ায় এটি চলচ্চিত্র প্রেমীদের জন্যও জনপ্রিয় গন্তব্য।

নিউজিল্যান্ডের সাফল্য দেখায় যে একটি ছোট দেশও সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

O

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *