পুরো দেশের জন্য একটি বড় পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ, কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

পুরো দেশের জন্য একটি বড় পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ, কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?

ভারত এমন একটি দেশ যা প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি করছে, তবে এই দ্রুত নগরায়নের ফলে বেশ কয়েকটি নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি হয়েছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণ এবং বর্জ্য নিষ্পত্তির কার্যকর ব্যবস্থার অভাবে, ভারতের বহু শহর এখন আবর্জনার পাহাড়ে পরিণত হচ্ছে। দেশজুড়ে শহরগুলি এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তবে এই সমস্যার সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায় দেশের রাজধানী দিল্লিতে।

গাজীপুর ডাম্পিং গ্রাউন্ড: বিপজ্জনক বাস্তবতা

দিল্লি তার ঐতিহাসিক ভবন, সংস্কৃতি এবং গতিশীলতার জন্য পরিচিত। তবে শহরের বাইরের একটি এলাকা রয়েছে যা এই আধুনিকতার উজ্জ্বলতার বিপরীতে কঠোর বাস্তবতা তুলে ধরে—গাজীপুর ডাম্পিং গ্রাউন্ড। এটি শুধুমাত্র দিল্লির সবচেয়ে বড় ল্যান্ডফিল নয়, এটি ভারতের অন্যতম উচ্চতম এবং বিশ্বের বৃহত্তম আবর্জনার পাহাড়গুলোর মধ্যে একটি। ভারতের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতির ব্যর্থতার একটি স্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে, এই ল্যান্ডফিল একটি সুউচ্চ ভবনের মতো বেড়ে চলেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যদি এটি নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তবে এটি শীঘ্রই কুতুব মিনারের চেয়েও উঁচু হতে পারে।

এই প্রতিবেদনে, আমরা গাজীপুর ডাম্পিং গ্রাউন্ডের ভয়াবহ বাস্তবতা, আশেপাশের এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবনে এর প্রভাব এবং এই পরিবেশগত বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলি বিশদভাবে বিশ্লেষণ করব।

একটি আবর্জনার পাহাড়

গাজীপুর ল্যান্ডফিল সাইট, যা ১৯৮৪ সালে কার্যক্রম শুরু করেছিল, দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে কারণ দিল্লির আবর্জনা এখানে ফেলা হয়। এটি দিল্লির পূর্বাঞ্চলে বর্জ্য নিষ্পত্তির জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এটি দিল্লির তিনটি প্রধান ল্যান্ডফিলের একটি, অন্য দুটি হলো ভলসওয়া এবং ওখলা।

প্রতিদিন এখানে ২০০০ টনের বেশি বর্জ্য ফেলা হয়, যা এই পাহাড়কে ক্রমাগত উচ্চতর করে তুলছে। তবে, ২০০২ সালে এটি তার সর্বোচ্চ ক্ষমতায় পৌঁছেছিল, কিন্তু তারপরও সেখানে প্রতিদিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। বর্তমানে, এটি প্রায় ৭০ একর জমিতে বিস্তৃত এবং এতে ১৪০ লাখ টনেরও বেশি বর্জ্য জমা হয়েছে।

এই ডাম্পিং গ্রাউন্ড শুধুমাত্র একটি বিশ্রী দৃশ্য নয়, এটি মারাত্মক পরিবেশগত এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণও হয়ে উঠেছে। পচনশীল আবর্জনা থেকে মিথেনের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনে অবদান রাখে। এছাড়াও, বিষাক্ত রাসায়নিক এবং ভারী ধাতু মাটিতে এবং ভূগর্ভস্থ জলে মিশে আশেপাশের এলাকাগুলোকে দূষিত করছে।

কুতুব মিনারের উচ্চতার চেয়ে মাত্র ৮ মিটার কম

গাজীপুর ল্যান্ডফিল ভারতের সর্বোচ্চ আবর্জনার স্তূপ হিসাবে পরিচিত, যা “আবর্জনার পাহাড়” নামে পরিচিত। বর্তমানে, এটি ৬৫ মিটার (২১৩ ফুট) উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা কুতুব মিনারের (৭৩ মিটার) উচ্চতার চেয়ে মাত্র ৮ মিটার কম।

আবর্জনার পাহাড়ের নিচে জীবন

গাজীপুর ডাম্পিং গ্রাউন্ডের আশেপাশে বসবাসকারী মানুষের জীবন এক অবিরাম সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যায়। হাজারো মানুষ, যার মধ্যে শিশুরাও রয়েছে, প্রতিদিন আবর্জনার স্তূপে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী খোঁজে, যা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা কোনও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই বিষাক্ত রাসায়নিক এবং সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে।

এলাকাবাসীদের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস এবং নিরাপদ জল এখন বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূষিত জলর ব্যবহারের কারণে ত্বকের রোগ, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা এবং হজমজনিত গুরুতর অসুস্থতা সাধারণ হয়ে উঠেছে।

কোন এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত?

গাজীপুর ল্যান্ডফিল সাইটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে গাজীপুর, ত্রিলোকপুরী, কল্যাণপুরী, আনন্দ বিহার, বিবেক বিহার, দিলশাদ গার্ডেন ও শাহদারা। এসব এলাকার মানুষ প্রতিনিয়ত দুর্গন্ধ, বিষাক্ত গ্যাস এবং জলদূষণের শিকার হচ্ছে।

গাজীপুর ল্যান্ডফিল কেন বাড়ছে?

১. বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কার্যকর অভাব – প্রতিদিন দিল্লিতে উৎপন্ন ১০,০০০ টনেরও বেশি বর্জ্যের বেশিরভাগই আধুনিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত হয় না, ফলে ল্যান্ডফিলে জমা হতে থাকে।
২. পুনর্ব্যবহার এবং বর্জ্য পৃথককরণের অভাব – গৃহস্থালির বর্জ্য “ভেজা” ও “শুষ্ক” হিসেবে আলাদা না করেই ফেলে দেওয়া হয়, যা ল্যান্ডফিলের ওপর চাপ বাড়ায়।
3. বর্ধিত জনসংখ্যা এবং নগরায়ন – দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যার কারণে বর্জ্যের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
4. বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানার অভাব – দিল্লিতে পর্যাপ্ত “Waste-to-Energy” প্ল্যান্ট নেই, যার ফলে বর্জ্য নিষ্পত্তির জন্য ল্যান্ডফিলের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গাজীপুর ল্যান্ডফিল মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপ

  1. বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন: গাজীপুরে “Waste-to-Energy” প্ল্যান্ট চালু হয়েছে, যা প্রতিদিন ২০০০ টন বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করছে।
  2. বর্জ্য পৃথককরণ: গৃহস্থালির আবর্জনা ভেজা ও শুকনো বর্জ্যে আলাদা করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
  3. বায়োমাইনিং প্রযুক্তির ব্যবহার: বর্জ্য পৃথক করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান সংগ্রহ এবং অবশিষ্টাংশের বৈজ্ঞানিক নিষ্পত্তি করা হচ্ছে।
  4. নতুন ল্যান্ডফিল স্থাপন: দিল্লি সরকার নতুন ল্যান্ডফিলের স্থান নির্ধারণ করছে, যাতে গাজীপুরের ওপর চাপ কমানো যায়।

সম্ভাব্য সমাধান

  1. Zero Waste মডেল গ্রহণ – প্লাস্টিক ও অন্যান্য অ-বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য হ্রাস করা।
  2. সরাসরি উৎসে বর্জ্য পৃথককরণ – প্রতিটি বাড়ি, অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কঠোরভাবে বর্জ্য পৃথককরণ বাস্তবায়ন।
  3. Waste-to-Energy প্ল্যান্ট স্থাপন – বিদ্যমান প্ল্যান্টগুলোর সম্প্রসারণ করা।
  4. বায়োমাইনিং ও প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি উন্নয়ন – আবর্জনা কমিয়ে পরিবেশবান্ধব ব্যবহার নিশ্চিত করা।
  5. বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কঠোর আইন প্রয়োগ – পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও অ-বায়োডিগ্রেডেবল উপকরণের ব্যবহারে কঠোর নিয়ম করা।
  6. সংশ্লিষ্ট শিল্পের বেসরকারিকরণ – পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেলে কচরা ব্যবস্থাপনা শিল্পকে উন্নত করা।

উপসংহার

গাজীপুর ল্যান্ডফিল কেবল দিল্লির সমস্যা নয়, এটি পুরো দেশের জন্য একটি কঠিন বাস্তবতা। কার্যকরী পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এই সংকট সমাধান সম্ভব, অন্যথায় এর প্রভাব আরও বিধ্বংসী হতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *