চীনে ফেব্রুয়ারি মাসে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি হার (CPI) শূন্যের নিচে নেমে গেছে। অর্থনীতিতে চলমান মন্দা ও মূল্যহ্রাস (ডিফ্লেশন) চীনের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যকে ভেঙে ফেলছে।

পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে বাজারে ক্রেতারই অভাব, আর বড় ছাড় দেওয়ার পরও পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। বেইজিং-এর ওয়্যাংকলাই স্টোর দিনে চারবার ফ্ল্যাশ সেল আয়োজন করে, তবুও ক্রেতারা কেনাকাটা থেকে দূরে থাকছেন। স্টোরের ম্যানেজার লিও লিউ জানান, 239 ইউয়ান (₹2800) মূল্যের জ্যাকেট তারা মাত্র 20 ইউয়ান (₹230)-তে বিক্রি করতেও হিমশিম খাচ্ছেন। শুধু ওয়্যাংকলাই নয়, পুরো বাজারেই গ্রাহকদের অভাব অনুভূত হচ্ছে। এমনকি, ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাতা BYD ও ক্যাফে চেইন স্টারবাকসের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও চাপে ফেলে দিয়েছে এই পরিস্থিতি।

চীনে মূল্যস্ফীতি নেগেটিভ, যা অর্থনীতির জন্য অশুভ সংকেত

রবিবার ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস (NBS) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে ভোক্তা মূল্যসূচক (CPI) বার্ষিক ভিত্তিতে 0.7% হ্রাস পেয়েছে, যেখানে জানুয়ারিতে এটি 0.5% বৃদ্ধি পেয়েছিল। কোনো দেশের জন্য মূল্যস্ফীতির শূন্যের নিচে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়। ডিফ্লেশন বা মূল্যহ্রাস অর্থনীতিতে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, ঋণের বোঝা বাড়ে, এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। চীনেও ঠিক এই সমস্যাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

গ্রাহকেরা কেনাকাটা করছে না

চীনের মন্দা এত গভীর যে দোকানদারদের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বড় অঙ্কের ছাড় দিতে হচ্ছে। বেইজিং-এর ফাইন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্টের কাছে ওয়্যাংকলাই স্টোর বিভিন্ন পোশাক, স্ন্যাকস ও গৃহস্থালি সামগ্রী বিক্রি করে। কিন্তু ক্রেতাদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় লাভ তো দূরের কথা, খরচও উঠছে না।

স্টোরের ম্যানেজার লিও লিউ বলেন, “আমাদের ব্যবসা কম লাভে দ্রুত পণ্য বিক্রির মডেলে চলে, কিন্তু এখন তো লোকসান দিয়েও বিক্রি করতে হচ্ছে।” তিনি আরও জানান, 39 ইউয়ান (₹450) মূল্যের মহিলা আন্ডারশার্ট বিনামূল্যেও দিতে হয়েছে, কারণ কেউ কিনতে চায়নি।

বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও সঙ্কটময়

এটি শুধু ছোট দোকানদারদের সমস্যা নয়। চীনের ইলেকট্রিক গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান BYD-কেও গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে দাম কমাতে হচ্ছে। কো ম্পা নিটি কিছু গাড়ির দাম 10,000 ডলার পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে।

বাজারে ক্রেতা আকৃষ্ট করতে ডিসকাউন্টের যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে কফি ব্র্যান্ড স্টারবাকসের ওপরও। চীনের স্থানীয় কফি ব্র্যান্ড Luckin Coffee তাদের দাম কমিয়ে বাজারে স্টারবাকসকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।

এমনকি, চীনের রেস্তোরাঁগুলোও খাবারের দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এখন মাত্র 3 ইউয়ান (₹35)-তে ব্রেকফাস্ট মিলছে।

ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও কমছে খরচ

চীনে যুব বেকারত্বের হার 15.7%-এ পৌঁছেছে, যার ফলে মানুষ খরচ করতে ভয় পাচ্ছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে লোকজন সঞ্চয়ে মনোযোগ দিচ্ছে এবং প্রয়োজন ছাড়া কেনাকাটা এড়িয়ে চলছে।

34 বছর বয়সী অর্থনৈতিক নিরীক্ষক লিলি লিউ বলেন, “আমার বেতন আগের তুলনায় কমে গেছে। চাকরি হারানোর ভয় সবসময় থাকে, তাই এখন শুধুমাত্র ডিসকাউন্ট স্টোর থেকে কেনাকাটা করি।”

বায়োলজি গ্রাজুয়েট ভিভিয়ান লিউ, যিনি এখনও ফুল-টাইম চাকরি না পেয়ে পার্ট-টাইম কাজ করছেন, বলেন, “আমি দোকানে শুধু ঘুরতে আসি, কেনার মতো টাকা নেই।”

চীনের অর্থনীতি কি আরও ধাক্কা খাবে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত ডিসকাউন্ট এবং গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস চীনের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠান এখন মুনাফার চেয়ে বাজারে টিকে থাকার দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে, ফলে পুরো শিল্পখাতেই খরচ ও দামের প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে।

চীন কি এই অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারবে, নাকি পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আপাতত, 239 ইউয়ানের জ্যাকেট মাত্র 20 ইউয়ানে বিক্রি হওয়া চীনের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলছে।

O