রাতে শোনা যায় পায়েলের ছনছন শব্দ, এক রহস্যময় প্রাসাদ যেখানে ৩০০ বছর ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক রাণীর আত্মা
এক ছিল রাজা, এক ছিল রাণী। এমন উত্তেজনাপূর্ণ কল্পকাহিনি আমরা সবাই ছোটবেলায় শুনেছি। কিন্তু আমাদের বিশেষ প্রতিবেদনে যে রাণীর গল্প বলা হচ্ছে, তা কোনো কল্পনা নয়, বরং এক ঐতিহাসিক সত্য।
এই প্রতিবেদনটি আমরা সেই প্রাসাদের ইতিহাসের ভিত্তিতে তৈরি করেছি, যাকে নিয়ে বলা হয়— রাণীর আত্মা এখনও এখানে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কে ছিলেন সেই রাণী? প্রাসাদে এমন কী ঘটেছিল, যার কারণে তাকে জল জহর করতে হয়েছিল? ইতিহাসের পাতায় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যায়, কিন্তু রাণীর আত্মা? এটি এখনও ভোপালের এই জল-মহলে এক গভীর রহস্য…
এক রহস্যময় জল-মহল, যেখানে শোনা যায় পায়েলের শব্দ
অজস্র রহস্যময় চলচ্চিত্রের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠা এই জল-মহল এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এখনও এই মহলের নিচের অংশ থেকে শোনা যায় রহস্যময় পায়েলের শব্দ। বহু মানুষ এই শব্দ শুনেছেন। অনেকের মতে, পায়েলের ছনছন এতটাই স্পষ্ট শোনা যায় যে মনে হয়, মহলের রাণী এখনও এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
কোথা থেকে আসে পায়েলের এই শব্দ?
জি মিডিয়ার একটি দল এই রহস্য বোঝার জন্য ভোপালের রাণী কমলাপতির জল-মহলে পৌঁছেছিল। উপরের দিক থেকে দেখলে, এটি যেন ইতিহাসের কোনো খোলা বই। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের রক্ষণাবেক্ষণে থাকা এই প্রাচীন স্থাপত্যে প্রবেশ করলেই বোঝা যায়, এটি রাণী কমলাপতির মহল।
রাণী কমলাপতি ছিলেন ভোপালের শেষ হিন্দু শাসক। মহলের উপরের অংশে থাকা জাদুঘরে তার ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু মহলের বাইরে এমন সব গল্প ছড়িয়ে আছে, যা যেকোনো দর্শনার্থীর মনে ভয় সৃষ্টি করতে পারে। শুধু রাতেই নয়, দিনের বেলাতেও কেউ মহলের নিচের অংশে প্রবেশ করতে পারে না। তবে জি নিউজের দলকে কিছু সময়ের জন্য নিচের অংশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
মহলের গোপন রহস্য: পাঁচটি তল জলের নিচে ডুবে আছে
মহলের প্রথম রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এর গঠনে। এটি যতটা উপরে দেখা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি অংশ মাটির নিচে রয়েছে। বড় জলাশয়ের পাশেই অবস্থিত এই মহলটির দুটি তল এখনও দৃশ্যমান, কিন্তু পাঁচটি তল জলের নিচে ডুবে গেছে।
এক সময়ে এই মহল জলাশয়ের জলর সমতলে ছিল, তাই একে জল-মহল বলা হয়। আমাদের দল এই মহল সম্পর্কে গবেষণা করেছিল এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছিল। তারা জানিয়েছিলেন, মহলের নিচের অংশে গেলে সাবধান থাকতে হবে, কারণ সেখানে যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। মহলের নিচে যাওয়ার অনুমতি সাধারণত কারও দেওয়া হয় না। আমরা যখন নিচে নামলাম, তখন একটি বিশাল চেইন-গেট দেখতে পেলাম, যার অর্থ সামনের পথ বন্ধ।
রাণীর সৌন্দর্য হয়ে উঠেছিল অভিশাপ
আজ থেকে ৩০০ বছর আগে, যখন ভোপালের এই মহল রাণী কমলাপতির সৌন্দর্যে আলো ছড়াচ্ছিল, তখন তার নাম রাখা হয়েছিল ‘কমলাপতি’, কারণ তিনি ফুটন্ত পদ্মফুলের মতো সুন্দর ছিলেন। তিনি ছিলেন মহারাজার কন্যা, অপরূপা এবং গুণবতী। কিন্তু তার সৌন্দর্যই তার জীবনের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।
স্বামীর নির্মিত জল-মহল
ভোপালের শেষ হিন্দু শাসক রাণী কমলাপতি ছিলেন তার অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য প্রসিদ্ধ। ১৭০২ সালে তার স্বামী রাজা নিজাম শাহ এই মহল তৈরি করেছিলেন, বিশেষভাবে রাণীর জন্য। একসময় এই মহল বিশাল জলাশয়ের মধ্যে অবস্থিত ছিল, যার সাতটি তলের মধ্যে পাঁচটি তল জলের নিচে ছিল। বলা হয়, পদ্মফুল ও জল ছিল রাণীর অত্যন্ত প্রিয়, তাই রাজা নিজাম শাহ তার জন্য এই মহল নির্মাণ করেছিলেন।
মহলের ভেতরে একটি গোপন সুড়ঙ্গও ছিল, যা এখনও বিদ্যমান।
তীরন্দাজি ও যুদ্ধকৌশলে দক্ষ রাণী
রাণী কমলাপতি শুধু সুন্দরীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধাও। তিনি ছিলেন সিহোর রাজ্যের রাজা কৃপাল সিং সরৌতিয়ার কন্যা। তিনি তীরন্দাজি, অশ্বারোহণ এবং কুস্তির মতো বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি নারীদের নিয়ে একটি বিশেষ সৈন্যদলও গঠন করেছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেন।
স্বামীর হত্যার প্রতিশোধ নিতে ব্যাকুল ছিলেন রাণী
রাণীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছিল জমিদার পুত্র চৈন সিং। কিন্তু রাণী তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরবর্তীতে, চৈন সিং রাজা নিজাম শাহকে হত্যার পরিকল্পনা করে। একদিন তিনি রাজাকে ভোজে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিষ খাইয়ে হত্যা করেন। স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হন রাণী কমলাপতি। তখন তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ১২ বছর বয়সী পুত্র নবল শাহকে রক্ষা করা এবং চৈন সিং-এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া।
আফগান সর্দারের সঙ্গে চুক্তি এবং বিশ্বাসঘাতকতা
চৈন সিং-এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে, রাণী এক আফগান সর্দার দোস্ত মোহাম্মদের সাহায্য নেন। তিনি এক লক্ষ মোহর দিয়ে দোস্ত মোহাম্মদকে চৈন সিং-এর দুর্গে আক্রমণ করতে বলেন। আক্রমণে চৈন সিং নিহত হয় এবং গিন্নৌরগড় দুর্গ দোস্ত মোহাম্মদের দখলে চলে যায়।
কিন্তু এরপর দোস্ত মোহাম্মদের মনোভাব বদলে যায়। তিনি রাণীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চান এবং পুরো রাজ্য দখল করতে চান। এই পরিস্থিতিতে, রাণীর পুত্র নবল শাহ ১০০ সৈন্য নিয়ে দোস্ত মোহাম্মদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন, কিন্তু যুদ্ধে শহিদ হন।
পুত্রের মৃত্যুর পর রাণীর জল জহর
নবল শাহের মৃত্যুর পর রাণী বুঝতে পারেন, দোস্ত মোহাম্মদ অচিরেই মহল আক্রমণ করবে। তিনি তার সব গয়না ও স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে জলাশয়ে ডুবে আত্মাহুতি দেন। এই ধরনের জল জহর ইতিহাসে বিরল।
এখনও বলা হয়, দোস্ত মোহাম্মদ পুরো জলাশয় খুঁজেও রাণীর মৃতদেহ বা তার সঙ্গে ডুবে যাওয়া সম্পদ খুঁজে পায়নি। এবং সেই রাত থেকে, মহলে প্রতি রাতে শোনা যায় পায়েলের রহস্যময় ছনছন শব্দ…