বোর্ডিংয়ে পড়াশোনা এবং চীনা শেখার বাধ্যতামূলকতা, তিব্বতের পরিচয় মুছে ফেলার জন্য কীভাবে শিক্ষাকে ব্যবহার করছে বেইজিং?

চীনের পরিচয় শুধু তার দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি নয়, বরং তার সম্প্রসারণবাদী মনোভাবও। ঋণ প্রদান করে সে অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। এছাড়াও, এমন অনেক দেশ রয়েছে যেগুলোকে চীন বরাবরই নিজের অংশ বলে দাবি করে আসছে।
তিব্বত তাদের মধ্যে একটি। সম্প্রতি চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, তারা তিব্বতের নতুন প্রজন্মকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য বর্ণনার নিয়ন্ত্রণ করছে। এর জন্য তারা পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন থেকে শুরু করে নানা কৌশল গ্রহণ করছে।
ফেব্রুয়ারি মাসে জেনেভা সামিটে, এক তিব্বতী কর্মী নামকি অভিযোগ করেন যে, যখন তিনি ১৫ বছর বয়সী ছিলেন, তখন তিনি বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেছিলেন। এরপর থেকে তিনি শি জিনপিং সরকারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। বছরের পর বছর ধরে তাকে হুমকি দেওয়া হয়, বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যার কারণে ২০২৩ সালে তাকে তিব্বত ছেড়ে পশ্চিমা দেশে আশ্রয় নিতে হয়। উল্লেখ্য, চীন দীর্ঘদিন ধরেই তিব্বতের ওপর দাবি জানিয়ে আসছে এবং ভিন্ন মত পোষণকারীদের ওপর নানা রকমের বিধিনিষেধ ও নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে।
তিব্বতের ওপর চীনের দাবি কেন?
চীনের মতে, তিব্বত প্রাচীনকাল থেকেই তাদের অংশ। তবে তিব্বতের ইতিহাস অস্থিরতায় ভরা। এক সময় এটি মঙ্গোলিয়ার শাসনে ছিল, আবার কখনো চীনা রাজবংশের শাসনাধীন ছিল। ১৯৫০-এর দশকে, বেইজিং সরাসরি সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে তিব্বতকে দখল করে নেয়। কিছু অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়, আর কিছু অংশকে চীনের অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
এর প্রায় এক দশক পর, তিব্বতে চীনা দখলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটে, যা ব্যর্থ হয়। সে সময় দালাই লামাকে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়। এরপর থেকে চীন তিব্বতকে নিজের অংশ বলে দাবি করে আসছে এবং যে দেশগুলো তিব্বতকে সমর্থন করে, তারা চীনের রোষানলে পড়ে।
তিব্বতের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন চীনকে সহজে গ্রহণ করে, সে জন্য বেইজিং পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে শিশুদের জীবনযাত্রাতেও পরিবর্তন আনছে। দ্য ডিপ্লোম্যাট-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিব্বতী শিশুদের জোরপূর্বক সরকারি আবাসিক স্কুলে পাঠানো হচ্ছে, যেখানে তারা বাবা-মায়ের থেকে দূরে থাকে এবং শুধুমাত্র স্কুলের শেখানো বিষয়গুলোই শিখতে পারে।
তিব্বত অ্যাকশন ইনস্টিটিউট-এর তথ্য অনুযায়ী, তিব্বতের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে ইতিমধ্যেই চার লাখের বেশি শিশু বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়েছে। মোট এক মিলিয়নেরও বেশি শিশু তাদের পরিবার থেকে আলাদা হয়েছে। শিশুদের এই স্কুলগুলোতে পাঠানো বাধ্যতামূলক করতে পুরোনো তিব্বতী স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
বেইজিং প্রশাসন তিব্বতে নতুন শিক্ষানীতি চালু করেছে, যেখানে তিব্বতী ভাষার পরিবর্তে মান্দারিন ভাষায় পড়ানো হচ্ছে। যদিও চীন দাবি করছে যে, এই বোর্ডিং স্কুলগুলোতে দুই ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি আসলে ছলচাতুরী। চীনে এডুকেশন মডার্নাইজেশন ২০৩৫ পরিকল্পনা কার্যকর হয়েছে, যার লক্ষ্য আগামী এক দশকের মধ্যে পুরো দেশকে শি জিনপিং-এর নীতির ছাঁচে ঢেলে ফেলা। এখানে “উচ্চমানের শিক্ষা” দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করা হলেও, এর সাথে দেশপ্রেমও শেখানো হচ্ছে। পাঠ্যক্রমে চীনা বীরদের কাহিনি এবং সংস্কৃতির উপর জোর দেওয়া হচ্ছে, যেখানে তিব্বতের অস্তিত্ব প্রায় মুছে ফেলা হয়েছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিব্বতী বাবা-মায়েদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। যদি কোনো অভিভাবক তার সন্তানকে এই স্কুলগুলোতে পাঠাতে অস্বীকার করেন, তবে তাদের সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
স্কুল ব্যবস্থার পরিবর্তনের ওপর কেন এত জোর?
চীনের বিরুদ্ধে আগেও বর্ণনা নিয়ন্ত্রণের (Narrative Control) অভিযোগ উঠেছে। হংকং এবং ম্যাকাওর স্কুলগুলোতেও পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করা হয়েছিল, যা চীনের পক্ষে ছিল।
উদাহরণস্বরূপ, হংকংয়ে কয়েক বছর আগে ন্যাশনাল এডুকেশন কারিকুলাম চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছিল, যেখানে চীনের সাফল্যের কথা বলা হয়েছিল। এতে তিয়ানানমেন স্কয়ার গণহত্যার মতো বিতর্কিত বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হয়েছিল এবং কেবলমাত্র কমিউনিস্ট সরকারের ইতিবাচক দিকগুলোই দেখানো হয়েছিল। ব্যাপক প্রতিবাদের পর এই প্রস্তাব বাতিল করা হয়।
কোভিড মহামারির সময় ন্যাশনাল সিকিউরিটি ল প্রয়োগের মাধ্যমে স্কুল ও কলেজগুলোতে দেশপ্রেম বাধ্যতামূলক করা হয়। এখন স্কুলে চীনের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।
শিক্ষাকে অস্ত্র বানিয়েছে যেসব দেশ
- যুক্তরাষ্ট্র: মার্কিন স্কুলগুলোতে দাসপ্রথা এবং নেটিভ আমেরিকানদের গণহত্যার ইতিহাস হালকাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঠান্ডাযুদ্ধের সময়, কমিউনিজমকে খলনায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে সম্পূর্ণ নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
- যুক্তরাজ্য: ব্রিটিশ পাঠ্যক্রমে উপনিবেশবাদকে সভ্যতা প্রচারের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখানো হয়েছে এবং এর নেতিবাচক দিকগুলো লুকিয়ে ফেলা হয়েছে।
- চীন: চীনের পাঠ্যবইগুলোতে তিয়ানানমেন স্কয়ার গণহত্যার কোনো উল্লেখ নেই। এমনকি উইঘুর মুসলিমদের ওপর নিপীড়নকে “সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযান” হিসেবে দেখানো হয়।
- ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন: উভয় পক্ষের শিক্ষাব্যবস্থায় একই ঘটনাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। উভয়ই নিজেদের সঠিক এবং বিপরীত পক্ষকে ভুল প্রমাণ করতে পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করেছে।
চীনের শিক্ষানীতির এই পরিবর্তন যে কেবল তিব্বতের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিলীন করে দিচ্ছে তা নয়, বরং এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চেতনা পরিবর্তন করারও একটি বড় প্রচেষ্টা।