শি’র হুঁশিয়ারি: ‘চীন কাউকে ভয় পায় না’, আমেরিকার ১৪৫% শুল্কের জবাবে ১২৫% শুল্ক আরোপ

শি’র হুঁশিয়ারি: ‘চীন কাউকে ভয় পায় না’, আমেরিকার ১৪৫% শুল্কের জবাবে ১২৫% শুল্ক আরোপ

বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৪৫% শুল্ক আরোপের পাল্টা জবাবে চীন ১২৫% শুল্ক আরোপ করেছে, যা ১২ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং কঠোর ভাষায় বলেছেন, “চীন কাউকে ভয় পায় না। পৃথিবী যতই বদলাক, আমরা চিন্তিত নই। কোনো দেশের চাপের কাছে আমরা মাথা নত করব না।” এই ঘোষণা বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তার সূচনা করেছে।

বাণিজ্য যুদ্ধের সূত্রপাত

এই বাণিজ্য সংঘাতের সূত্রপাত গত ৫ মার্চ, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘টিট ফর ট্যাট’ নীতির অধীনে বিভিন্ন দেশের উপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। চীনের পণ্যের উপর প্রাথমিকভাবে ৩৪% শুল্ক আরোপের পর ট্রাম্প পর্যায়ক্রমে এটি বাড়িয়ে ১০৪%-এ নিয়ে যান। ৯ এপ্রিল চীন পাল্টা ৮৪% শুল্ক ঘোষণা করে। তবে ট্রাম্প শুল্ক আরও বাড়িয়ে ১৪৫%-এ নিয়ে যান, যার মধ্যে ফেন্টানাইলের উপর ২০% অতিরিক্ত শুল্ক এবং অন্যান্য সমন্বয়ে ১% যুক্ত হয়।

চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই পদক্ষেপকে “আমেরিকার ব্ল্যাকমেইলিং মনোভাব” বলে অভিহিত করেছে। এক বিবৃতিতে তারা বলে, “আমেরিকা একের পর এক ভুল করছে। আমরা বাণিজ্য যুদ্ধ চাই না, তবে যদি তা অবশ্যম্ভাবী হয়, চীন সম্পূর্ণ প্রস্তুত।” শুক্রবার চীন ১২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে জানায়, তারা আর অতিরিক্ত শুল্কের জবাব দেবে না, যা বোঝায় যে তারা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করতে চায় না।

শি জিনপিংয়ের অবস্থান

স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের সঙ্গে এক বৈঠকে শি জিনপিং বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে স্পষ্ট বার্তা দেন। তিনি বলেন, “বাণিজ্য যুদ্ধে কোনো বিজয়ী হয় না। পৃথিবীর বিরুদ্ধে যাওয়া মানে নিজের বিরুদ্ধে যাওয়া।” তিনি চীনের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার উপর জোর দিয়ে বলেন, “গত ৭০ বছরে চীন কঠোর পরিশ্রম ও স্বনির্ভরতার মাধ্যমে উন্নতি করেছে। আমরা কখনো অন্যের অনুদানের উপর নির্ভর করিনি, কারো বলপ্রয়োগেও ভীত হই না।”

শি’র এই বক্তব্য চীনের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. লি চেং বলেন, “শি জিনপিং জাতীয় গর্ব ও আত্মবিশ্বাসের উপর জোর দিয়ে দেশের জনগণকে একত্রিত করতে চাইছেন। একই সঙ্গে তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়কে বোঝাতে চাইছেন যে চীন চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না।”

বাণিজ্য যুদ্ধের কারণ ও প্রভাব

এই বাণিজ্য যুদ্ধের মূলে রয়েছে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা, প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা এবং ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য। আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে চীন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি চুরি এবং আসাম বাণিজ্য নীতির মাধ্যমে তাদের ক্ষতি করছে। অন্যদিকে, চীন দাবি করে, আমেরিকা তাদের অর্থনৈতিক উত্থান রোধ করতে শুল্কের মতো হাতিয়ার ব্যবহার করছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই শুল্ক যুদ্ধ বিশ্ব বাণিজ্যের পরিমাণ ২০২৫ সালে ১.৫% কমিয়ে দিতে পারে। চীনের আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থা এবং আমেরিকার ভোক্তা বাজার উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের শুল্কের ফলে মার্কিন কৃষিপণ্য, যেমন সয়াবিন ও শুকরের মাংস, রপ্তানি ৩০% পর্যন্ত কমতে পারে। একইভাবে, আমেরিকার শুল্ক চীনের ইলেকট্রনিক পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে, যা মার্কিন ভোক্তাদের জন্য ব্যয় বাড়াবে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

স্পেনের প্রধানমন্ত্রী সানচেজ বৈঠকে উভয় পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “মুক্ত বাণিজ্য বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। আমরা চাই না এই সংঘাত ইউরোপের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলুক।” ইউরোপীয় ইউনিয়নও এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা উভয় দেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে প্রস্তুত।

অন্যদিকে, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এই পরিস্থিতির মধ্যে সুযোগ দেখছে। ভারতীয় বাণিজ্য বিশ্লেষক অঞ্জনা রায় বলেন, “চীন ও আমেরিকার মধ্যে শুল্ক যুদ্ধ ভারতের টেক্সটাইল ও প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করতে পারে। তবে বিশ্ব বাজারে অস্থিরতা আমাদের জন্যও চ্যালেঞ্জ।”

জনগণের প্রতিক্রিয়া

চীনের নাগরিকদের মধ্যে শি’র বক্তব্য জাতীয়তাবাদী উত্সাহ জাগিয়েছে। বেইজিংয়ের একজন ব্যবসায়ী লিউ হান বলেন, “আমরা আমাদের দেশের সঙ্গে আছি। আমেরিকার চাপ আমাদের আরও শক্তিশালী করবে।” তবে কেউ কেউ উদ্বিগ্ন। সাংহাইয়ের একজন শিক্ষার্থী ঝাং মেই বলেন, “এই যুদ্ধ আমাদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।”

অন্যদিকে, আমেরিকার কৃষক ও শিল্পপতিরা শুল্কের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। ওহাইওর একজন কৃষক জন মার্টিন বলেন, “চীন আমাদের সয়াবিন কেনা বন্ধ করলে আমরা বিপদে পড়ব। এই যুদ্ধ কারো জন্য ভালো নয়।”

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই শুল্ক যুদ্ধ দ্রুত সমাধান না হলে বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, “উভয় দেশকে আলোচনার টেবিলে ফিরতে হবে। বাণিজ্য যুদ্ধ বিশ্বের প্রবৃদ্ধিকে হুমকির মুখে ফেলছে।”

চীনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ বোঝায় যে তারা আরও শুল্ক বাড়ানোর পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেবে। তবে আমেরিকা যদি নতুন করে চাপ সৃষ্টি করে, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *