ক্যাপ্টাগন: সন্ত্রাসীদের ‘শয়তানি ট্যাবলেট’ যা ভয় ও করুণা মুছে দেয়

ক্যাপ্টাগন: সন্ত্রাসীদের ‘শয়তানি ট্যাবলেট’ যা ভয় ও করুণা মুছে দেয়

ক্যাপ্টাগন নামে একটি বিপজ্জনক মাদকদ্রব্য সন্ত্রাসীদের হাতে শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এই ট্যাবলেট ভয়, ক্লান্তি ও ব্যথাকে দমন করে, একজন সাধারণ মানুষকে হিংস্র ও নির্মম করে তুলতে পারে। হামাস ও আইসিসের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এই মাদক ব্যবহার করে তাদের আক্রমণের তীব্রতা বাড়াচ্ছে। ইসরায়েলে সাম্প্রতিক হামলায় নিহত সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে এই ট্যাবলেট উদ্ধার হওয়ায় বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ছড়িয়েছে।

ক্যাপ্টাগন কী ও এর উৎপত্তি

ক্যাপ্টাগন, যার রাসায়নিক নাম ফেনেথিলিন, মূলত ১৯৬০-এর দশকে জার্মানিতে মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য তৈরি হয়েছিল। এটি অ্যামফেটামিন জাতীয় মাদক, যা মস্তিষ্কে ডোপামিন ও নোরপাইনফ্রিনের মাত্রা বাড়িয়ে ব্যবহারকারীকে অতিরিক্ত সতর্ক, শক্তিশালী ও উদ্দীপিত রাখে। তবে ১৯৮০-এর দশকে এর নেশা সৃষ্টিকারী গুণের কারণে বেশিরভাগ দেশে এটি নিষিদ্ধ হয়।

এখন এই মাদকের প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র সিরিয়া। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের অশান্ত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অবৈধ কারখানাগুলো ক্যাপ্টাগন তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিরিয়া থেকে প্রতি বছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ক্যাপ্টাগন মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে পাচার হচ্ছে।

সন্ত্রাসীদের হাতে ক্যাপ্টাগন

ক্যাপ্টাগন সন্ত্রাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় কারণ এটি তাদের দীর্ঘ সময় ধরে আক্রমণ চালানোর ক্ষমতা দেয়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, গত বছর হামাসের হামলায় নিহত কয়েকজন সন্ত্রাসীর কাছ থেকে ক্যাপ্টাগন ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে। একজন আইডিএফ মুখপাত্র বলেন, “এই মাদক সন্ত্রাসীদের মানসিকভাবে অসাড় করে দেয়। তারা ভয়, ক্লান্তি বা করুণা অনুভব করে না, যা তাদের হিংস্রতাকে আরও ভয়াবহ করে।”

এর আগে, ২০১৫ সালে প্যারিস হামলার সময় আইসিস সন্ত্রাসীদের কাছ থেকেও এই ট্যাবলেট পাওয়া গিয়েছিল। জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ ড. ইয়ারন শোয়ার্জ বলেন, “ক্যাপ্টাগন সন্ত্রাসীদের জন্য একটি মানসিক অস্ত্র। এটি তাদের স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তি মুছে দেয়, যার ফলে তারা নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে।”

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব

ক্যাপ্টাগনের ব্যবসা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর জন্য একটি বড় আর্থিক উৎস। সিরিয়ার একটি গোপন কারখানা থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ ট্যাবলেট পাচার হয়, যার মাধ্যমে হামাস, হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য গোষ্ঠী বিপুল অর্থ উপার্জন করে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক সংস্থা (ইউএনওডিসি) জানায়, এই অর্থ সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অস্ত্র ক্রয় এবং প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরব, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, ক্যাপ্টাগনের বিস্তার নিয়ে উদ্বিগ্ন। সৌদি আরবের একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, “এই মাদক আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংস করছে। আমরা এর চোরাচালান রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি।” ২০২৪ সালে সৌদি আরব ৫০ মিলিয়ন ক্যাপ্টাগন ট্যাবলেট জব্দ করেছে, যা এর বিস্তারের ভয়াবহতা প্রকাশ করে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও চ্যালেঞ্জ

ক্যাপ্টাগনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জরুদি। তবে সিরিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দুর্বল শাসন ব্যবস্থা এই মাদকের উৎপাদন ও পাচার রোধে বড় বাধা। ইউরোপোলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিরিয়া থেকে লেবানন হয়ে ইউরোপে ক্যাপ্টাগন পাচার বেড়েছে, যা স্থানীয় অপরাধী সংগঠনগুলোর হাতে পড়ছে।

জর্ডানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা প্রতিদিন চোরাচালানকারীদের সঙ্গে লড়াই করছি। কিন্তু ক্যাপ্টাগনের চাহিদা এত বেশি যে এটি বন্ধ করা প্রায় আসাম্ভব।” সৌদি আরব ও আমিরাতে ক্যাপ্টাগন ধরা পড়লে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত শাস্তি হলেও চোরাচালান অব্যাহত রয়েছে।

সামাজিক ও মানবিক প্রভাব

ক্যাপ্টাগন শুধু সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র নয়, এটি সাধারণ মানুষের জীবনও ধ্বংস করছে। মধ্যপ্রাচ্যে তরুণরা এই মাদকের নেশায় আসক্ত হচ্ছে। রিয়াদের একজন সমাজকর্মী ফাতিমা আল-শেখ বলেন, “আমরা প্রতিদিন এমন পরিবারের সঙ্গে কাজ করি, যাদের সন্তানরা ক্যাপ্টাগনের কারণে জীবন হারিয়েছে। এটি একটি সামাজিক বিপর্যয়।”

চিকিৎসকরা জানান, দীর্ঘমেয়াদে ক্যাপ্টাগন মানসিক রোগ, হৃদরোগ এবং লিভারের ক্ষতি করে। ড. হাসান ইব্রাহিম, বৈরুতের একজন নিউরোলজিস্ট, বলেন, “এই মাদক মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে যে ব্যবহারকারী স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না।”

সমাধানের পথ

ক্যাপ্টাগনের বিস্তার রোধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সিরিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং অর্থনৈতিক সংস্কার এই মাদক ব্যবসার মূল কাটতে পারে। এছাড়া, সৌদি আরবের মতো দেশগুলো চাহিদা কমাতে জনসচেতনতা বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছে।

ইউএনওডিসি’র একজন মুখপাত্র বলেন, “ক্যাপ্টাগনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুধু আইনি ব্যবস্থা নয়, শিক্ষা, পুনর্বাসন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নও দরকার।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *