আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার ঝলক : জানুন আপনার শহরের সর্বশেষ রেট

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং আমেরিকা-চীনের মধ্যে তীব্র শুল্ক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। শুক্রবার, মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জে (এমসিএক্স) সোনার দাম প্রতি ১০ গ্রামে ৯৩,৭৩৬ টাকায় উঠে যায়, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। রূপার দামও শক্তি দেখিয়েছে, প্রতি কেজি ৯২,৫৮৮ টাকায় পৌঁছে। এই অভূতপূর্ব বৃদ্ধি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে তীব্র আগ্রহ জাগিয়েছে।
এমসিএক্সে সোনা-রূপার উত্থান
শুক্রবার সকাল ১০:৩০ নাগাদ, এমসিএক্সে জুন ডেলিভারির সোনার চুক্তি ৯২,৪৬৩ টাকায় খোলা হয়, যা আগের দিনের বন্ধ মূল্য ৯২,০৩৩ টাকার তুলনায় ৪৩০ টাকা বেশি। দিনের লেনদেনে দাম ৯৩,৭৩৬ টাকায় পৌঁছে এবং বর্তমানে প্রতি ১০ গ্রামে ৯৩,২৫৯ টাকায় লেনদেন হচ্ছে, যা ১.৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে। “অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে সোনা বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কাজ করছে। এই বৃদ্ধি বাজারের আস্থার প্রতিফলন,” বলেন কলকাতা-ভিত্তিক কমোডিটি বিশ্লেষক সৌম্যজিৎ দাস।
রূপার বাজারও সমানভাবে উত্তেজনাপূর্ণ। মে মাসের ডেলিভারির রূপার চুক্তি ৯২,০০০ টাকায় খোলার পর দিনের সর্বোচ্চ ৯২,৫৮৮ টাকায় পৌঁছায়। বর্তমানে এটি প্রতি কেজি ৯২,৩৭৫ টাকায় লেনদেন হচ্ছে, যা ০.৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি। “রূপার দাম বৃদ্ধি শিল্প চাহিদা এবং বিনিয়োগের আকর্ষণের মিশ্র ফলাফল। এটি ইলেকট্রনিক্স এবং সৌরশক্তি খাতে ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের কারণেও উৎসাহিত হচ্ছে,” বলেন কেডিয়া অ্যাডভাইজরির এমডি অজয় কেডিয়া।
আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার ঝলক
আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দামও রেকর্ড গড়ছে। মার্কিন ফিউচারে সোনার দাম ৩,২৩৬ ডলার প্রতি আউন্সে পৌঁছেছে, যা সর্বকালের সর্বোচ্চ। স্পট গোল্ড বর্তমানে ৩,২১৬.৪৮ ডলারে লেনদেন হচ্ছে। এই সপ্তাহে সোনার দাম ৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। “আমেরিকা-চীন শুল্ক যুদ্ধ তীব্র হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি এড়াতে সোনার দিকে ঝুঁকছেন। চীনের পণ্যে আমেরিকার ১৪৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি এবং চীনের পাল্টা শুল্ক এই উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়েছে,” বলেন লন্ডন-ভিত্তিক বাজার বিশ্লেষক এমিলি চ্যাং।
শহরভিত্তিক সোনা ও রূপার দাম
ভারতের প্রধান শহরগুলোতে সোনা ও রূপার দামও এই বৈশ্বিক প্রবণতার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে:
- দিল্লি: ২৪ ক্যারেট সোনা প্রতি ১০ গ্রামে ৯৫,৫৫০ টাকা, ২২ ক্যারেট ৮৭,৬০০ টাকা; রূপা প্রতি কেজি ৯৭,১০০ টাকা।
- মুম্বাই: ২৪ ক্যারেট সোনা ৯৫,৪০০ টাকা, ২২ ক্যারেট ৮৭,৪৫০ টাকা; রূপা ৯৭,১০০ টাকা।
- কলকাতা: ২৪ ক্যারেট সোনা ৯৫,৪০০ টাকা, ২২ ক্যারেট ৮৭,৪৫০ টাকা; রূপা ৯৮,০০০ টাকা।
- চেন্নাই: ২৪ ক্যারেট সোনা ৯৫,৪০০ টাকা, ২২ ক্যারেট ৮৭,৪৫০ টাকা; রূপা ১,০৮,০০০ টাকা।
“শহরভিত্তিক দামের এই পার্থক্য স্থানীয় চাহিদা, পরিবহন খরচ এবং করের প্রভাবে ঘটে। চেন্নাইয়ে রূপার দাম বেশি হওয়ার কারণ সেখানকার শিল্প চাহিদা,” বলেন দিল্লির বুলিয়ন ব্যবসায়ী রাকেশ গুপ্তা।
কেন বাড়ছে দাম?
সোনা ও রূপার দাম বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, আমেরিকা-চীন শুল্ক যুদ্ধ তীব্রতর হয়েছে। আমেরিকা চীনা পণ্যে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক বাড়িয়েছে, যার জবাবে চীনও পাল্টা শুল্ক আরোপ করছে। এই বাণিজ্য উত্তেজনা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। “যখন শেয়ার বাজার বা অন্যান্য বিনিয়োগে ঝুঁকি বাড়ে, সোনার চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। এটি মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ,” বলেন কেডিয়া।
দ্বিতীয়ত, মুদ্রাস্ফীতি এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের আশঙ্কা বিনিয়োগকারীদের সোনার প্রতি আকৃষ্ট করছে। তৃতীয়ত, ভারতে বিবাহের মরসুম এবং উৎসবের সময় নিকটবর্তী হওয়ায় সোনার চাহিদা বাড়ছে। “এই সময়ে গয়নার চাহিদা বেড়ে যায়, যা দামের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে,” বলেন মুম্বাইয়ের জুয়েলারি ব্যবসায়ী প্রিয়াঙ্কা শর্মা।
ভবিষ্যৎ প্রবণতা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সোনার দামে ওঠানামা অব্যাহত থাকবে। কেডিয়া অ্যাডভাইজরি অনুমান করছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম ৩,৩২০ ডলার প্রতি আউন্স এবং এমসিএক্সে প্রতি ১০ গ্রামে ৯৫,০০০ টাকায় পৌঁছাতে পারে। “বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য সোনা এখনও আকর্ষণীয়, তবে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগে সতর্কতা প্রয়োজন,” বলেন বাজার বিশ্লেষক রাহুল মেহতা।
রূপার দামও শিল্প চাহিদা এবং বিনিয়োগের প্রবাহের কারণে বাড়তে পারে। “রূপার দাম প্রতি কেজি ১,০০,০০০ টাকার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে, বিশেষ করে সৌরশক্তি ও ইলেকট্রনিক্স খাতে এর ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে,” বলেন কেডিয়া।
ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ
এই দাম বৃদ্ধি সাধারণ ক্রেতাদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করলেও বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ। “বিবাহ বা উৎসবের জন্য সোনা কিনতে চাইলে হলমার্কযুক্ত গয়না বেছে নিন এবং দামের তুলনা করুন। বিনিয়োগের জন্য সোনার বিস্কুট বা ইটিএফ ভালো বিকল্প,” বলেন জুয়েলারি ব্যবসায়ী শর্মা। তিনি আরও যোগ করেন, “দামের অস্থিরতার কারণে ক্রয়ের সময় সতর্ক থাকুন।”