তেলের জন্য রাশিয়া, সেনার জন্য আমেরিকা: মোদীর ‘সুপারপ্ল্যান’ কি বদলে দিচ্ছে ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশল?

তেলের জন্য রাশিয়া, সেনার জন্য আমেরিকা: মোদীর ‘সুপারপ্ল্যান’ কি বদলে দিচ্ছে ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশল?

ভারত দ্রুত রাশিয়ার প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে, যা একটি বড় পরিবর্তন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভারত রাশিয়া থেকে অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে এবং পশ্চিমা সরবরাহকারী, বিশেষ করে আমেরিকা ও ফ্রান্সের দিকে ঝুঁকছে।

এই পরিবর্তন মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোর জন্য বিশাল সুযোগ তৈরি করছে, কারণ তারা এখন বিলিয়ন ডলারের চুক্তি পাচ্ছে। ভারতের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা উন্নত এবং নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি পেতে তাদের উৎসকে বৈচিত্র্যময় করছে।

ইউএস-ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ ফোরামে মার্কিন বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিক জানিয়েছেন, আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে দ্রুত একটি বড় ব্যবসায়িক চুক্তি হতে পারে।

লুটনিকের মতে, ভারত এখন আমেরিকা থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা শুরু করছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। প্রশ্ন হলো, কেন ভারত রাশিয়ার অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে?

রাশিয়ার অস্ত্র থেকে কেন মুখ ফেরাচ্ছে ভারত?

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) অনুসারে, রাশিয়া থেকে ভারতের প্রতিরক্ষা আমদানি ২০০৯ সালের ৭৬ শতাংশ থেকে কমে গত বছর ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ১৯৬০-এর দশকের পর এই প্রথম রাশিয়ার অংশ অর্ধেকের নিচে নেমে গেল। এই পরিবর্তন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাশিয়া নির্ভরতা কমানোর কৌশলের অংশ। ভারত রাশিয়ার সঙ্গে শুধু তেল কেনা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।

ব্লুমবার্গ ভারতীয় কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে হেলিকপ্টার এবং উন্নত যুদ্ধবিমান তৈরির মতো যৌথ প্রকল্পগুলো স্থগিত করা হয়েছে। ভারতীয় ক্রুদের প্রশিক্ষণের জন্য রুশ পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন ইজারা নেওয়ার প্রস্তাবও সম্ভবত এগোবে না। ইউক্রেন সংঘাত শুরুর আগে অর্ডার করা দুটি যুদ্ধজাহাজ এবং অ্যান্টি-মিসাইল শিল্ড ব্যাটারিই শুধু রাশিয়া থেকে আসার অপেক্ষায় আছে।

অন্যদিকে, রাশিয়া ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে ভারতকে বাকি S-400 বিমান প্রতিরক্ষা ইউনিট সরবরাহ করতে প্রস্তুত। মিশনের উপ-প্রধান রোমান বাবুশকিন নিশ্চিত করেছেন, চুক্তিটি কোনো বিলম্ব ছাড়াই ঠিক পথে আছে। বিশেষ করে পুলওয়ামা হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘাতে এর ব্যাপক সাফল্য দেখা গেছে, যা এটিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ভারত ২০১৮ সালে ৫টি স্কোয়াড্রনের জন্য ৫.৪৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছিল, যার মধ্যে তিনটি স্কোয়াড্রন ইতোমধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ বাড়িয়েছে পরিবর্তনের গতি

ইউক্রেনের যুদ্ধ রাশিয়ার প্রতিরক্ষা উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতায় ফাটল ধরিয়েছে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার সুশান্ত সিংয়ের মতে, অ্যান্টি-মিসাইল শিল্ড সরবরাহে বিলম্ব “রাশিয়ার দুর্বল সক্ষমতার প্রমাণ”। রাশিয়ার চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যার ইলেকট্রনিক্সের ওপর তারা অতিমাত্রায় নির্ভরশীল, ভারতীয় সামরিক পরিকল্পনাকারীদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। কিংস কলেজ লন্ডনের সামরিক নীতি বিশেষজ্ঞ আনিত মুখার্জি ব্লুমবার্গকে জানিয়েছেন, রুশ প্রতিরক্ষা শিল্পের চীনা ইলেকট্রনিক্সের ওপর নির্ভরতা ভারতের জন্য বিপদের ঘণ্টা।

তবুও, ভারত এখনও তার বর্তমান অস্ত্র, যার মধ্যে রাইফেল, ট্যাঙ্ক এবং যুদ্ধবিমান রয়েছে, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যন্ত্রাংশের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। সিংয়ের মতে, এগুলো কয়েক দশক ধরে পরিষেবা দেবে এবং ভারতের দীর্ঘকাল রাশিয়ার যন্ত্রাংশ ও গোলাবারুদের প্রয়োজন হবে। কিন্তু ভবিষ্যৎ অন্য দিকে।

আমেরিকা ও পশ্চিমা সরবরাহকারীদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা

২০১৮ সাল থেকে ভারত মার্কিন তৈরি প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের জন্য প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সম্প্রতি দেশটি জেনারেল অ্যাটমিক্স থেকে ৩১টি দূরপাল্লার ড্রোনের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি অনুমোদন করেছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (HAL) এবং জেনারেল ইলেকট্রিক ভারতের পরবর্তী প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের জন্য যৌথভাবে উন্নত জেট ইঞ্জিন তৈরির চুক্তি চূড়ান্ত করার কাছাকাছি।

একজন সিনিয়র কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রুশ অস্ত্র শুরুতে সস্তা হলেও বারবার মেরামতের প্রয়োজন হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে সেগুলো বেশি ব্যয়বহুল হয়। মুখার্জি বলেছেন, ভারত ধীরে ধীরে পশ্চিমা প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছে, কারণ সেনাবাহিনী এই প্রযুক্তির সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে।

তেলের জন্য রাশিয়া, প্রতিরক্ষার জন্য আমেরিকা

মোদীর পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য হলো সতর্কতার সঙ্গে সম্পর্কগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করা। মস্কোর ওপর সামরিক নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি ভারত ছাড়যুক্ত মূল্যে রুশ তেল কেনা চালিয়ে যেতে চায় এবং কূটনৈতিক সমর্থন দিতে চায়। এদিকে, আমেরিকার কাছ থেকে প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে উন্নত প্রযুক্তি ও কর্মসংস্থান লাভ করতে চায়। এই পরিবর্তন আমেরিকা-ভারত প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।

গুণগত মান ও উৎপাদন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ

রুশ সরঞ্জামের গুণগত মান নিয়ে ভারতের সন্দেহ ইউক্রেন যুদ্ধেরও আগে থেকে ছিল। কিছু রুশ সরঞ্জাম, যেমন মিগ-২৯কে যুদ্ধবিমান, প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজের স্বস্তি রাও সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার দুর্বল পারফরম্যান্সে ভারত বিস্মিত হয়েছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “প্যাট্রিয়টস কিভাবে কিনজাল ক্ষেপণাস্ত্রকে ভূপাতিত করল, যা অজেয় বলে মনে করা হয়েছিল? রুশ জাহাজগুলো এত সহজ লক্ষ্যবস্তু কিভাবে হচ্ছে…?”

এছাড়াও, ভারতের দেশীয় যুদ্ধবিমান কর্মসূচি আংশিকভাবে থমকে আছে, কারণ আমেরিকা-ভিত্তিক জেনারেল ইলেকট্রিক জেট ইঞ্জিন সরবরাহে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এটি অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে চ্যালেঞ্জ এবং পশ্চিমা প্রযুক্তি হস্তান্তরের গুরুত্ব তুলে ধরে।

পারমাণবিক সক্ষমতা

ভারতের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা এখনও রয়েছে, যেমন মুখার্জি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “রাশিয়া একমাত্র দেশ যারা ভারতকে পারমাণবিক সাবমেরিন দেয়।” যতক্ষণ না পারমাণবিক প্রযুক্তির সমস্যাগুলোর সমাধান হয়, ততক্ষণ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের ব্যাপক অংশীদারিত্ব আসাম্পূর্ণ থাকবে। ভারত ভবিষ্যতে অস্ত্র কেনার জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে, যা পশ্চিমা সরবরাহকারীদের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে যারা সহ-উৎপাদন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য আগ্রহী। এই সুযোগ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গভীর করবে এবং আধুনিক, আত্মনির্ভর সামরিক শিল্প গড়ে তুলতে ইচ্ছুক সংস্থাগুলোকে উপকৃত করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *