মোদীজি বলছেন ‘যুদ্ধের যুগ নয়’, ইরান-ইসরায়েলে নীরবতার পেছনে ভারতের কোন ‘ভয়’ কাজ করছে?

মোদীজি বলছেন ‘যুদ্ধের যুগ নয়’, ইরান-ইসরায়েলে নীরবতার পেছনে ভারতের কোন ‘ভয়’ কাজ করছে?

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ: ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পর আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের কূটনীতি আবারও আলোচনায় এসেছে। ইসরায়েল গত সপ্তাহে ইরানের ওপর হামলা চালালে ভারতের পক্ষে কোনো একটি পক্ষের সমর্থন করা সহজ ছিল না।

কিন্তু এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন ভারত নিজেকে এমন অনেক মঞ্চে নিরপেক্ষ রাখে যেখানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছিল।

ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে গত কয়েক বছরে সম্পর্ক মজবুত হয়েছে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠতার পর। অন্যদিকে, ভারত ও ইরানের সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গভীরতা নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে শক্তি, বাণিজ্য এবং কৌশলগত অংশীদারিত্বও অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের সময় একটি বিবৃতি সামনে আসে, যা এই নীরবতার পেছনের কারণ বলে মনে করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন যে এটি যুদ্ধের যুগ নয়। কিন্তু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই জারি থাকবে।

জাতিসংঘের ভারতের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন
১২ জুন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে (UNGA) গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবিতে ভোট হয়। এতে ১৪৯টি দেশ যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে ভোট দেয়, যেখানে ১২টি দেশ বিরোধিতা করে এবং ১৯টি দেশ ভোটদানে অংশ নেয়নি। ভারত ভোটদান থেকে বিরত থেকে নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়, কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে ভারতের এই ‘নীরবতা’ অনেক বার্তা দিচ্ছে। ভারতের সাথে ভোটদান থেকে বিরত থাকা অন্যান্য দেশ যেমন টোগো, পানামা, দক্ষিণ সুদান এবং মালাউইকে বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী দেশ হিসেবে ধরা হয় না।

এসসিও এবং ব্রিক্সেও ভিন্ন পথ
১৪ জুন সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO) ইরানের ওপর ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করে একটি বিবৃতি জারি করে। ভারত এসসিও-এর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এই বিবৃতি থেকে বিরত থাকে। একইভাবে ব্রিক্সের অধিকাংশ সদস্য দেশও হামলার নিন্দা জানায়, কিন্তু ভারত ও ইথিওপিয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব থেকে নিজেদের দূরে রাখে। কোয়াডের সদস্য জাপান ও অস্ট্রেলিয়া যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দেয়, যেখানে ভারত আবারও নিরপেক্ষতা দেখায়।

বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া
দ্য হিন্দুর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের এই অবস্থান ঐতিহ্যবাহী ভারসাম্যবাদ থেকে সরে এসে ঝুঁকির দিকে ইঙ্গিত করে। প্রাক্তন বিদেশ সচিব কনওয়াল সিব্বালও স্বীকার করেছেন যে ভারত এখন একটি কূটনৈতিক দ্বিধায় রয়েছে, যেখানে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক এবং এসসিও-এর মতো মঞ্চের সদস্যতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।

ভারতের প্রাক্তন জাতিসংঘ প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিনের মতে, আজকের বিশ্বে ভারতের ভূমিকা বড় হয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে তার ‘নীরবতা’ও একটি বিবৃতি হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, বিশ্ব মঞ্চে এখন ভারতকে শুধু জিজ্ঞাসা করা হবে না যে সে কী করেছে, বরং সে কী বলছে বা কোন বিষয়ে নীরব রয়েছে।

পশ্চিম এশিয়ায় ভারসাম্যের নীতি?
থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো তানভি মাদান-এর মতে, ভারত ঐতিহ্যগতভাবে ইরান, ইসরায়েল এবং উপসাগরীয় দেশগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে আসছে। কিন্তু বর্তমান ঘটনাপ্রবাহে ভারতের ঝোঁক স্পষ্টতই ইসরায়েলের দিকে দেখা যাচ্ছে, যদিও সরকার ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করেনি বা সমর্থনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও করেনি।

রাশিয়া-ইরান জোটের মধ্যে ভারত কোথায়?
রাশিয়া, যা ভারতের পুরনো কৌশলগত অংশীদার, ইরানের উপর ইসরায়েলি হামলার সমালোচনা করছে। রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ইরানি প্রতিপক্ষের সাথে ফোনে কথা বলে হামলার নিন্দা করেছেন এবং মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন। ইরান, ব্রিক্স এবং এসসিও উভয়েরই সদস্য, তবুও ভারত তার সাথে খোলাখুলি সম্পর্ক বাড়াতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে।

আমেরিকার প্রভাব?
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা আসে, কিন্তু এর সাথে ভারতের উপর ইরানের সাথে সম্পর্ক সীমিত রাখার চাপও তৈরি হয়। ১৯৯০-এর দশকে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী তেল সংকট এবং অর্থনৈতিক চাপ ভারতকে তার পররাষ্ট্রনীতিতে বাস্তববাদীতা গ্রহণ করতে বাধ্য করে।

পশ্চিম এশিয়ায় চলমান সংঘাত এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের ভূমিকা নিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলির মধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট: ভারত এখন বিশ্ব ব্যবস্থায় একজন নিষ্ক্রিয় দর্শক নয়। তার নীরবতা, বিবৃতি এবং ভোটিং প্যাটার্ন এখন বৈশ্বিক সমীকরণে নির্ণায়ক গুরুত্ব রাখে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতকে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি এটিও নির্ধারণ করতে হবে যে কখন এবং কীভাবে তার অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *