যুদ্ধের ছায়ায় কীভাবে একটি খবর ইরানে ‘ইসলামিক বিপ্লব’ নিয়ে এল, নারীদের ঘরে বন্দি করে ইসরায়েলকে শত্রু বানিয়েছিল?

যুদ্ধের ছায়ায় কীভাবে একটি খবর ইরানে ‘ইসলামিক বিপ্লব’ নিয়ে এল, নারীদের ঘরে বন্দি করে ইসরায়েলকে শত্রু বানিয়েছিল?

ডিজিটাল ডেস্ক, নয়াদিল্লি। ইসরায়েল এবং ইরান একে অপরের উপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। উভয় দেশেই ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। ইরান ইসরায়েলের উপর ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (Ballistic Missiles) নিক্ষেপ করেছে, যার জবাবে ইসরায়েলও ইরানকে ছিন্নভিন্ন করেছে।

যুদ্ধের পরিস্থিতির মধ্যে এই আলোচনা তীব্র হয়েছে যে, যখন ইরানকে মানুষ পারস্য (Persia) নামে চিনত, তখন সেখানকার জীবন কতটা সুখের ছিল। সেখানে মেয়েদের পড়াশোনা করার এবং স্কুলে যাওয়ার অধিকার ছিল, ভোট দেওয়ার এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার ছিল। স্কার্ট (Skirt) পরা এবং গাঢ় রঙের লিপস্টিক (Lipstick) লাগিয়ে ঘোরার স্বাধীনতাও ছিল। তারপর একদিন বিপ্লব (Revolution) এল এবং পুরো দেশ বদলে গেল। একটি আধুনিক ও উন্নত দেশ ইসলামিক রাষ্ট্রে (Islamic Nation) পরিণত হলো।

এখন প্রশ্ন ওঠে যে, সেই ‘ইরানের ইসলামিক বিপ্লব’ (Islamic Revolution of Iran) আসলে কী ছিল, যার ফলে একটি দেশের চেহারা, চরিত্র এবং ভাগ্য বদলে গেল, যার ফলে উদার চিন্তাভাবনার পারস্য মুসলিম দেশ ইরানে রূপান্তরিত হলো? আসুন, আমরা আপনাকে বলি… এই গল্পটি দীর্ঘ হলেও, আমাদের চেষ্টা হল আপনাকে সহজ শব্দে এবং অল্প সময়ের মধ্যে পুরো ঘটনাটি জানানো।

আজ থেকে ৪৭ বছর, ৫ মাস এবং ১৪ দিন আগে অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি, ১৯৭৮ সালের সকাল ইরানের মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। সকালে মানুষ সংবাদপত্র পড়ল এবং কেউ সেটি ছিঁড়ে ফেলল, কেউ ফেলে দিল বা পুড়িয়ে দিল। এখান থেকেই ইসলামিক বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে, এবং মানুষ কোনো কিছু না ভেবেই রাস্তায় নেমে আসে।

এখন প্রশ্ন ওঠে যে, সংবাদপত্রে এমন কী ছাপা হয়েছিল, যা মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছিল।

একটি খবর এবং ২০ জনের মৃত্যু
সেই দিনগুলোতে ইরানের অন্যতম বৃহত্তম সংবাদপত্র ইত্তেলাত (Ettela’at)-এ একটি খবর ছাপা হয়েছিল, যেখানে লেখা ছিল – “আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি (Ayatollah Ruhollah Khomeini) একজন ব্রিটিশ এজেন্ট। তিনি উপনিবেশবাদের (Colonialism) সেবা করছেন।” শুধু তাই নয়, খবরে খোমেনির ইরানি পরিচয় নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। তার উপর অনৈতিক জীবনযাপনের অভিযোগও আনা হয়েছিল।

ইত্তেলাতে খবর ছাপার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই দেশে যেন আগুন লেগে গেল। পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হল যে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের দেখলেই গুলি চালানো হবে। এরপর আর কী, ২০ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন। অনেক সংবাদপত্রের উপর সেন্সরশিপ (Censorship) আরোপ করা হলো।

আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি কে ছিলেন?
আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি কে ছিলেন, যার সম্পর্কে খবর শুধু হাঙ্গামা সৃষ্টি করেনি, বরং ইরানকে একটি মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল? আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি একজন উলেমা (Ulema) ছিলেন। ৬০ থেকে ৭০ এর দশকে মাদ্রাসাগুলোতে তার ব্যাপক প্রভাব ছিল।

খোমেনির ভারতের সঙ্গেও সংযোগ ছিল। খোমেনির দাদা সৈয়দ আহমেদ মুসাভি (Sayyid Ahmad Mousavi) উত্তর প্রদেশের বারা বাঁকির (Barabanki) কিনতূর (Kintoor) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং সেখানেই বসবাস করতেন। ৪০ বছর বয়সে তিনি ইমাম আলীর (Imam Ali) দরগাহ, যা আলীর মসজিদ (Ali’s Mosque) নামেও পরিচিত, সেখানে মাথা ঠেকানোর জন্য ইরাকে (Iraq) গিয়েছিলেন।

ইরাক থেকে ইরানে এসে তিনি খোমেন (Khomeyn) শহরে অবস্থান করেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সৈয়দ আহমেদ মুসাভি তার নামের সাথে ‘হিন্দি’ উপাধি যোগ করেন, যার পর তাকে সৈয়দ আহমেদ মুসাভি হিন্দি নামে ডাকা হতে শুরু করে। ১৯০২ সালে মুসাভির নাতি আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি জন্মগ্রহণ করেন, যিনি পরে পড়াশোনা করে উলেমা হন।

ইরানের মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ার গল্প কী?
পারস্য… অর্থাৎ বর্তমান ইরান এবং পারস্য সাম্রাজ্য (Persian Empire)। এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (First World War) কথা। ব্রিটেন পারস্য অর্থাৎ ইরানকে তার সুরক্ষিত রাজ্য (Protected State) বানাতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই সময় পারস্য সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক রেজা শাহ (Reza Shah) এটা হতে দেননি।

রেজা শাহ সেনাবাহিনীতে ধীরে ধীরে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়েছিলেন। এই কারণেই সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও রেজা শাহের কাছে ছিল। রেজা শাহের মাথায় ইরানি পরিচয়কে শক্তিশালী করার একটি উন্মাদনা ছিল। এই কারণেই রেজা শাহ অতীতের ভাষা পহলভিকে (Pahlavi) তার নামের সাথে উপাধি হিসেবে যুক্ত করেছিলেন।

১৯২৫ সালে রেজা শাহ পহলভি উপাধি ধারণ করেন এবং এখান থেকে রাজতন্ত্রের (Monarchy) পহলভি যুগ শুরু হয়। রেজা শাহ পহলভি ১৯৪১ সাল পর্যন্ত পারস্য শাসন করেন। রেজার শাসন শেষ হওয়ার আগেই পারস্য অনেকটাই বদলে গিয়েছিল। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের কথা বললে, পারস্যের নাম পরিবর্তন করে ইরান রাখা হয়েছিল। জানা যায় যে, পারস্যের মানুষ এই অংশটিকে আগে থেকেই ইরান নামে ডাকত, তাই রেজা বহু বছর পর সেই নামটি পুনরুজ্জীবিত করে পারস্যকে ইরান করে দেন।

রেজা শাহ পহলভি ইরানকে একটি কেন্দ্রীভূত পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতা (Centralized Western Secular) এবং নারী সমর্থক (Pro-women) দেশ হিসেবে পরিচিতি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। রেজা নারীদের স্বার্থে শিক্ষা, রাজনীতি, কর্মসংস্থান, পোশাক এবং বিয়ের বয়স বাড়ানো সহ অনেক পরিবর্তন করেছিলেন।

পহলভি যুগে ইরানে মহিলাদের কী অধিকার ছিল?
মেয়েদের এবং মহিলাদের স্কুল/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অধিকার ছিল।
১৯৩৬ সালে হিজাব (Hijab) এবং বোরকা (Burqa) নিষিদ্ধ করা হয়। মহিলারা পশ্চিমা পোশাক পরতে পারতেন।
১৯৫০ সালে ইরানে বাল্যবিবাহ (Child Marriage) নিষিদ্ধ করা হয় এবং বিয়ের বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়।
১৯৬৩ সালে মহিলাদের ভোটাধিকার (Voting Right) দেওয়া হয়। সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকারও পান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *