ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার বৈশ্বিক প্রভাব

বিশ্বের ‘থানাদার’ হিসেবে পরিচিত আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার বন্ধু ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের শান্তির জন্য হুমকি হয়ে ওঠা কট্টরপন্থী ইসলামিক রাষ্ট্র ইরানের তিনটি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়ে একদিকে গত ১০ দিন ধরে চলা ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে একটি নতুন মোড় দিয়েছেন, অন্যদিকে তার এই অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপের মাধ্যমে চীন-রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলোকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের সীমায় থাকা উচিত, অন্যথায় পরিণতি আরও খারাপ হতে পারে।
এভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার বৈশ্বিক তাৎপর্য স্পষ্ট, যা এক-মেরু বিশ্বকে বহু-মেরু করার প্রচেষ্টার ব্যর্থতাকে তুলে ধরে। এর পাশাপাশি, এটি কিছু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক দিকের উপরও আলোকপাত করে, যা নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য
প্রথমত, ইরানের উপর মার্কিন হামলা থেকে আবারও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বর্তমান এক-মেরু বিশ্বে আমেরিকার সজাগ ও ধূর্ত নেতৃত্বকে অন-দ্য-স্পট চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষমতা এখনও রাশিয়া-চীন-উত্তর কোরিয়া জোটের নেই, বিশেষ করে নিজেদের উপর নির্ভরশীল দেশগুলোর জন্যও। এর কারণ হলো, যেখানে আমেরিকা তার মিত্র ন্যাটো দেশগুলো – ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া – ইত্যাদিকে আস্থায় নিয়ে ইসরায়েল ও ইউক্রেনের মতো তার মিত্রদের পক্ষে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেয়, সেখানে রাশিয়া-চীন-উত্তর কোরিয়ার মতো সিটো দেশগুলো শেষ মুহূর্তে সিরিয়া ও ইরানের মতো তাদের মিত্রদের উপর আসা বিপদ দূর করতে দ্রুত ঐক্যবদ্ধতা প্রদর্শন এবং প্রত্যাশিত সামরিক পাল্টা আক্রমণ শুরু করার ক্ষেত্রে দ্বিধাবোধ করে।
২. চীন-রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার কথায় ও কাজে পার্থক্য
দ্বিতীয়ত, চীন-রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার কথায় ও কাজে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এছাড়া, তারা নিজেদের মধ্যে দাবার চালের ক্ষেত্রেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এই কারণেই কখনও আফগানিস্তান, কখনও সিরিয়া এবং কখনও ইরানের মতো দেশগুলো তাদের হাত থেকে বেরিয়ে যায় এবং সেখানে আবারও আমেরিকার প্রভাব বেড়ে যায়। আপনারা দেখেছেন যে, যখন ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরান ইসরায়েলের উপর কর্তৃত্ব অর্জন করে এবং ইসরায়েলের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমও দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন হঠাৎ আমেরিকা তার পক্ষে এগিয়ে আসে এবং ইরানের ফোর্দো, নাতাঞ্জ এবং ইসফাহানে অবস্থিত পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করে।
৩. মার্কিন হামলার বিশেষ উদ্দেশ্য
তৃতীয়ত, এই মার্কিন হামলার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল, যা আমেরিকা ছাড়া অন্য কোনো ন্যাটো দেশ পূরণ করতে পারত না। উল্লেখ্য, ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা তেহরানের দক্ষিণে একটি পাহাড়ের নিচে অবস্থিত এবং অত্যন্ত গভীরে নির্মিত। এটি ইংলিশ চ্যানেল টানেলের চেয়েও গভীর বলে মনে করা হয়। এই কারণেই আমেরিকা তাদের হামলায় জিবিইউ (GBU)-57 ম্যাসিভ অর্ডনেন্স পেনিট্রেটর (MOP) নামক একটি ভারী বোমা ব্যবহার করেছে, যা ১৩,০০০ কিলোগ্রাম ওজনের এবং ৬১ মিটার মাটি বা ১৮ মিটার কংক্রিট ভেদ করতে পারে। তবে এই কেন্দ্রে কতটুকু ক্ষতি হয়েছে, তা কিছু সময় পর জানা যাবে, যখন সঠিক পরিসংখ্যান ও ছবি ইরান সরকার প্রকাশ করবে।
৪. ইরানের গোপন কৌশল ও বিকল্প ব্যবস্থা
চতুর্থত, মার্কিন হামলার প্রভাব সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য এখনও সামনে আসেনি। তবে এতটুকু বলা যায় যে, ইরান বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই তাদের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে হামলার আশঙ্কা করছিল, যা এবার সত্যি হলো। তাই ইরান তাদের গোপন কৌশল অনুযায়ী নিশ্চয়ই কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করে রেখেছে, যেমনটা অন্য একটি ইসলামিক দেশ পাকিস্তান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির অধীনে পাকিস্তানি শাসকদের নির্দেশে করে রেখেছে। এই কারণেই ইরানের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে, পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো আগে থেকেই খালি করে দেওয়া হয়েছিল এবং প্রয়োজনীয় পারমাণবিক গবেষণার সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। যদি এমনটা হয়ে থাকে, তবে এটি আমেরিকা-ইসরায়েলের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো।
৫. ট্রাম্পের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ইসরায়েলের চাপ
পঞ্চমত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, পারমাণবিক সাইটগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে অনেক প্রাক্তন মার্কিন কূটনীতিক মনে করেন যে, ইরানি পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস বা শেষ হয়ে গেছে, এটা বলা এখনও তাড়াহুড়ো হবে। সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলকে সন্তুষ্ট করার জন্য, অথবা কেবল লোক দেখানোর জন্য পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে হামলা করেছেন, কারণ ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী, ব্যবসা তার অগ্রাধিকার, এবং তিনি সম্ভবত আমেরিকাকে পূর্ণ যুদ্ধে জড়াতে চান না। এই কারণেই তিনি ইরান প্রশাসনকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, তিনি তাদের পারমাণবিক ঘাঁটিতে হামলা চালাবেন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি এবং জিউইশ কাউন্সিল ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্সের চাপে আছেন, যা রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট উভয়কেই অর্থায়ন করে। উল্লেখ্য যে, মার্কিন অর্থনীতি সেখানে বসবাসকারী ২ শতাংশ ইহুদিদের ইশারায়ই পরিচালিত হয়।
৬. পাকিস্তানের পারমাণবিক সুরক্ষার দৃষ্টান্ত
ষষ্ঠত, যদিও ইরানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে হামলার সম্ভাবনা দীর্ঘকাল ধরে প্রকাশিত হচ্ছিল, তাই ইরান প্রয়োজনীয় পারমাণবিক গবেষণা সরঞ্জাম সংরক্ষণের বিকল্প ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে। উল্লেখ্য যে, ইরানের মতো পাকিস্তানও তার পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে। পাকিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান ডিভিশন, যা ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির সচিবালয়, তাদের প্রয়োজনীয় পারমাণবিক গবেষণা সরঞ্জামের জন্য প্রায় ১৫টি গোপন স্থান তৈরি করেছে, যেখানে সময় সময় এটি রাখা হয়।
৭. পাকিস্তানের অতীত অভিজ্ঞতা ও পারমাণবিক হামলার আশঙ্কা
সপ্তমত, যদিও পাকিস্তানও ক্রমাগত এই আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছে যে, আমেরিকা, ভারত বা ইসরায়