যে রাশিয়াকে ইউরোপ ভয় পায়, তার জন্য আমেরিকা নিরপেক্ষ! দুই মহাশক্তির পথ কি এবার ভিন্ন হবে?

যে রাশিয়াকে ইউরোপ ভয় পায়, তার জন্য আমেরিকা নিরপেক্ষ! দুই মহাশক্তির পথ কি এবার ভিন্ন হবে?

এই সপ্তাহে ন্যাটো (NATO) বৈঠকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে: জেনারেল সেক্রেটারি মার্ক রুটে আমেরিকা এবং ইউরোপের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। আপাতত ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছু শর্তসাপেক্ষে ন্যাটোতে থাকতে রাজি বলে মনে হচ্ছে। তবে শুধু ন্যাটো নয়, দীর্ঘ দিন পর আমেরিকা ও ইউরোপকে যেন দুটি ভিন্ন শিবিরে দেখা যাচ্ছে। তাদের এক সময়ের অভিন্ন বন্ধু ও শত্রুরাও বদলে যাচ্ছে। এই দূরত্ব কি সাময়িক, যা ট্রাম্পের মেয়াদের সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে, নাকি সত্যিই তাদের মধ্যে পুরনো বোঝাপড়া আর নেই?

ইউএস-ইউরোপের মধ্যে এই দূরত্বের কারণ বুঝতে হলে তাদের কাছাকাছি আসার কারণগুলো একবার জেনে নেওয়া যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তারা ভিন্ন শিবিরে ছিল, একে অপরের বন্ধুও নয়, শত্রুও নয়। আসল অংশীদারিত্ব শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। সে সময় আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) একত্রিত হয়ে জার্মানি ও জাপানকে পরাজিত করে। যুদ্ধের পর ইউরোপ বিধ্বস্ত হয়েছিল, আর সোভিয়েত ইউনিয়ন শক্তিশালী হয়ে উঠছিল।

এই সময়ে ওয়াশিংটন ইউরোপকে অর্থনৈতিক শক্তি জোগানোর জন্য মার্শাল প্ল্যান (Marshall Plan) চালু করে। একই সাথে সামরিক দায়িত্ব পালনের জন্য ন্যাটো (NATO) গঠিত হয়। এখান থেকেই উভয়ের মধ্যে অভিন্ন স্বার্থ এবং ক্ষতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়। উভয়ের শত্রুও ছিল একই — সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইউরোপ দুর্বল ছিল বলে তাকে ভয় পেত, আর আমেরিকা শক্তিশালী ছিল বলে ভয় পেত, কারণ তারা তাদের ক্ষমতা অন্য কারো হাতে দিতে রাজি ছিল না।

ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ইউএস-ইউরোপের একটাই স্লোগান ছিল — এক জনের উপর আক্রমণ মানে সবার উপর আক্রমণ। এই পুরো সময় জুড়েই তারা বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত একসঙ্গে নিয়েছিল। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে, ফলে অভিন্ন শত্রু শেষ হয়ে যায়। আমেরিকার সামনে নতুন বিষয় চলে আসে — তারা মধ্যপ্রাচ্য, চিন এবং আফগানিস্তানের দিকে নজর দিতে শুরু করে। অন্যদিকে, ইউরোপের মনোযোগ তখনও একই জায়গায় আটকে ছিল, সাথে তাদের নতুন সমস্যা ছিল যেমন শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি।

সময়ের সাথে সাথে আমেরিকা এবং ইউরোপের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলেছে। ইউএস তার সুপার পাওয়ারের আসনে অটল রয়েছে, অন্যদিকে ইউরোপ দুর্বল হচ্ছে। ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে এসেই ন্যাটো থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিতে শুরু করেছেন। এটা ইউরোপের জন্য বড় ধাক্কা। বর্তমানে ইউরোপ ভীত। আসলে গত সাড়ে তিন বছর ধরে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। ইউক্রেন ইউরোপ এবং ইউএস থেকে সমর্থন পেয়ে আসছে। এখন যদি ইউএস তার হাত গুটিয়ে নেয়, তাহলে ইউক্রেন দুর্বল হয়ে পড়বে। এর অর্থ হলো, রাশিয়া ইউক্রেন হয়ে ইউরোপের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। এই কারণেই সীমান্তবর্তী এবং দূরবর্তী সব দেশ চিন্তিত যে, আজ না হোক কাল তাদেরও যেন এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না হয়।

অন্যদিকে, আমেরিকার মনোভাব সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা ধীরে ধীরে নিরপেক্ষ হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। সম্প্রতি এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে যেখানে ট্রাম্প প্রকাশ্যে পুতিনকে প্রশংসা করেছেন বা অসন্তোষ প্রকাশ করা থেকে বিরত থেকেছেন। ইউএস রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘাতে জড়ানো থেকে পিছিয়ে আসছে। বর্তমানে তাদের প্রধান চিন্তা হয়ে উঠেছে চিন, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আমেরিকাকে তার সুপার পাওয়ারের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। এখন ইউরোপের দেখভাল তাদের উদ্বেগের বিষয় নয়।

ইউরোপ এখনও সেখানেই আটকে আছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার প্রতি তাদের ভয় আরও বেড়েছে। তারা মনে করে, যদি রাশিয়াকে এখন না থামানো হয়, তাহলে ভবিষ্যতে সে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের সীমান্তেও পৌঁছে যাবে। এই কারণেই ইউরোপের ছোট থেকে বড় সব দেশ কিয়েভকে নিজেদের মতো করে সাহায্য দিচ্ছে। পাশাপাশি রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।

যখন উভয়ের দিক পরিবর্তন হবে, তখন এর প্রভাব বিশ্ব ভারসাম্যের উপর দেখা যাবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এর ফলে বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়বে।

যদি ইউএস-এর জন্য চিন বড় হুমকি হয় বা ইউরোপের জন্য রাশিয়া সম্ভাব্য বড় শত্রু হয়, তাহলে ন্যাটোর দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে। এর আভাস এখনই শোনা যাচ্ছে। অর্থায়ন নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।

যদি বড় দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য না থাকে, তাহলে জাতিসংঘ (United Nations)-এর মতো সংস্থাগুলোর কণ্ঠস্বর বা সিদ্ধান্ত দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ভেটো (Veto) ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন দেখা যাবে।

ইউএস-এর মনোযোগ এখন ইন্দো-প্যাসিফিক (Indo-Pacific) অঞ্চলে। অর্থাৎ, ভারত, জাপান বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক আরও ভালো হতে পারে। ইউরোপ এখানে পিছিয়ে পড়বে।

যদি আমেরিকা এবং ইউরোপ ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করে, তাহলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বাণিজ্য এবং অবশেষে মুদ্রার উপরও পড়তে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *