ট্রাম্পের ট্যারিফ খেলায় বাজিমাত করতে পারে ভারত! চিনকে পিছনে ফেলার প্রস্তুতি, কী আশা করা হচ্ছে এই চুক্তি থেকে?

ট্রাম্পের ট্যারিফ খেলায় বাজিমাত করতে পারে ভারত! চিনকে পিছনে ফেলার প্রস্তুতি, কী আশা করা হচ্ছে এই চুক্তি থেকে?

ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য আলোচনা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। নীতিনির্ধারকরা আশা করছেন যে এই চুক্তি থেকে ভারতের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা পূরণ হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমেরিকা কর্তৃক চিন ও ভারতের ওপর আরোপিত শুল্কের মধ্যে স্থায়ী পার্থক্য বজায় রাখা। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতিতে অনিশ্চয়তা রয়েছে, তবুও ভারত সরকার বিশ্বাস করে যে আমেরিকা চিন ও ভারতের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশের শুল্ক পার্থক্য বজায় রাখবে। যেমন, যদি আমেরিকা চিনের ওপর ৩০-৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, তাহলে ভারতের ওপর ২০-৩০ শতাংশ হওয়া উচিত।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে লিখেছে, “এই চুক্তি চূড়ান্ত করার এটাই সঠিক সময়, যাতে এই পার্থক্য বজায় থাকে।” যদিও আমেরিকান পক্ষ কৃষি ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের মতো রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল ক্ষেত্রগুলিতে বাজার প্রবেশের কঠোর দাবি জানাচ্ছে, যেখানে ভারতের সুস্পষ্ট ‘রেড লাইনস’ রয়েছে। ভারতের জন্য এই শুল্ক পার্থক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ভারতের কিছু কাঠামোগত দুর্বলতা যেমন অবকাঠামোগত বাধা, লজিস্টিকস সমস্যা, উচ্চ সুদের ব্যয়, ব্যবসা করার খরচ এবং দুর্নীতি ইত্যাদির ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। কর্মকর্তারা বলছেন, ২০% শুল্ক পার্থক্য এই দুর্বলতাগুলি কমাতে সহায়ক হতে পারে।

চুক্তির প্রত্যাশা ও ভারতের কৌশল
রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৪ জুন ট্রাম্প কর্তৃক চিনের ওপর ৫৫% শুল্ক ঘোষণার পর, ভারতের ওপর আরোপিত ২৬% শুল্কের তুলনায় এই পার্থক্য তাত্ত্বিকভাবে প্রায় ৩০ শতাংশ হতে পারে। তবে, এর কিছু শর্ত রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক পরিকল্পনা সাধারণত ১০ দিনেরও কম সময়ে পরিবর্তিত হয় এবং লন্ডনে উভয় পক্ষের মধ্যে সাম্প্রতিক আলোচনার পর চিনের ওপর আরোপিত নতুন শুল্ক কতদিন কার্যকর থাকবে তা স্পষ্ট নয়।

‘আর্লি হার্ভেস্ট ডিল’ কী?
প্রশ্ন হলো, ভারত কি সীমিত পরিসরের ‘আর্লি হার্ভেস্ট’ চুক্তিতে রাজি হবে, নাকি ৯ জুলাইয়ের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর আলোচনা স্থগিত রেখে পরে আবার চেষ্টা করবে? বর্তমানে একটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য চুক্তি সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

শুল্ক হ্রাসে ভারতের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, ভারত এখন কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে শুল্ক কমাতে আরও ইতিবাচক হয়েছে, বিশেষ করে ইন্টারমিডিয়েট গুডসে (মধ্যবর্তী পণ্য)। যদিও ভারত এর আগে RCEP চুক্তি থেকে সরে এসে কৃষি খাতের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, এখন আমেরিকার পছন্দের পণ্য—যেমন আপেল, বাদাম, আখরোট, অ্যাভোকাডো এবং ওয়াইনের ওপর শুল্ক হ্রাসের বিষয়ে ভারতে বেশি গ্রহণযোগ্যতা দেখা যাচ্ছে। এর পাশাপাশি, জিএম (জেনেটিক্যালি মডিফাইড) ফুডসের বিষয়েও ভারত এখন আরও উন্মুক্ত মনোভাব দেখাচ্ছে। ভারতের কাছে আমেরিকা থেকে অপরিশোধিত তেল, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম এবং পারমাণবিক উপকরণ আমদানিরও সুযোগ রয়েছে—যা ট্রাম্পের ক্রমাগত বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর দাবিকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে পারে।

তৃতীয় প্রত্যাশা: বেসলাইন শুল্ক এখন কি স্থায়ী?
তৃতীয় প্রধান বোঝাপড়া হলো, বিদ্যমান বেসলাইন শুল্ক এখন স্থায়ী হয়ে গেছে। সুতরাং ভারত আলোচনায় যা কিছু অর্জন করবে, তা ১০% থেকে ২৬% এর মধ্যে একটি কার্যকর শুল্কই হবে। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে আমেরিকা কর্তৃক ভারতের ওপর আরোপিত গড় শুল্ক ছিল মাত্র ৪% এবং অ-শুল্ক বাধা প্রায় ছিলই না। এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমেরিকার বন্দরগুলিতে চিনা পণ্যের ওপর আরোপিত কার্যকর শুল্ক কত, বিশেষ করে সেইসব বিভাগে যেখানে ভারত প্রতিযোগিতামূলক। রিপোর্ট অনুযায়ী, আমেরিকা ও চিনের মধ্যে যে শুল্ক পার্থক্য তৈরি হবে, তা ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমেই ভারতের কিছু কাঠামোগত দুর্বলতা—যেমন অবকাঠামোর অভাব, লজিস্টিকস সমস্যা, উচ্চ সুদের হার এবং দুর্নীতির ক্ষতিপূরণ হতে পারে।

ট্রাম্পের ৫৫% শুল্ক ঘোষণা, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন
১৪ জুন ট্রাম্প কর্তৃক চিনের ওপর ৫৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা একবার এমন ইঙ্গিত দিয়েছিল যে ভারতের ওপর আরোপিত ২৬% শুল্কের তুলনায় ৩০% পার্থক্য তৈরি হবে। কিন্তু এর অনেক জটিলতা রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প ঘোষিত ৫৫% শুল্কের মধ্যে ২৫% সেই পুরনো শুল্কও অন্তর্ভুক্ত, যা তার প্রথম মেয়াদে আরোপ করা হয়েছিল এবং যা বাইডেন প্রশাসনও বহাল রেখেছিল। এছাড়া, ১০% বেসলাইন ‘জবাবী’ শুল্ক এবং ২০% শুল্ক ফেন্টানিল চোরাচালানের অভিযোগে আরোপ করা হয়েছিল। অর্থাৎ, প্রকৃত শুল্ক পার্থক্য ততটা বড় নয় যতটা দেখা যায়।

চিনের শক্তিশালী অবস্থান, ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ
সম্প্রতি জেনেভায় অনুষ্ঠিত আলোচনায় আমেরিকা চিনা পণ্যের ওপর শুল্ক ১৪৫% থেকে কমিয়ে ৩০% করেছে এবং চিন মার্কিন আমদানির ওপর তার শুল্ক কমিয়ে ১০% করেছে। একই সঙ্গে, চিন আমেরিকাকে রেয়ার আর্থ খনিজ রপ্তানিতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—যা মার্কিন গাড়ি কো ম্পা নিগুলিকে স্বস্তি দিয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে চিনের দর কষাকষির ক্ষমতা বেড়েছে এবং যদি তারা আমেরিকা থেকে আরও ছাড় আদায় করতে পারে, তবে ভারতের জন্য প্রত্যাশিত শুল্ক পার্থক্য বজায় রাখা কঠিন হতে পারে।

ভারতের কৌশল ও চ্যালেঞ্জ
ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল মে মাসে আমেরিকা সফরের সময় মার্কিন বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, যাতে বাণিজ্য আলোচনা এগিয়ে নেওয়া যায়। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, আমেরিকা কৃষি ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের মতো রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল ক্ষেত্রগুলিতে বাজার প্রবেশের জন্য চাপ দিচ্ছে, যেখানে ভারতের সুস্পষ্ট সীমা রয়েছে। ভারত আশা করে যে আমেরিকা কর্তৃক চিনের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্কের কারণে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা মার্কিন বাজারে আরও বেশি সুযোগ পাবেন। বিশেষ করে সেইসব ক্ষেত্রে যেখানে ভারতীয় উৎপাদকরা প্রতিযোগিতামূলক, যেমন ইলেকট্রনিক্স, বস্ত্র এবং ফার্মাসিউটিক্যালস।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *