রাশিয়াকে কেন চ্যালেঞ্জ করছে মুসলিম দেশ আজারবাইজান? যুদ্ধের আঁচ, ভারতেরও ‘শত্রু’ এই দেশ

রাশিয়াকে কেন চ্যালেঞ্জ করছে মুসলিম দেশ আজারবাইজান? যুদ্ধের আঁচ, ভারতেরও ‘শত্রু’ এই দেশ

সম্প্রতি রাশিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে উত্তেজনা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দুটি দেশ একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল এবং দীর্ঘকাল ধরে একে অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, কিন্তু এখন তারা এক গুরুতর কূটনৈতিক বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। এই উত্তেজনার শুরু কিছু নির্দিষ্ট ঘটনা থেকে হয়েছে, যা উভয় দেশের সম্পর্কে গভীর আঘাত হেনেছে। আজারবাইজান সম্পর্কে বলে রাখা ভালো যে, ভারতের সঙ্গেও এই দেশটির সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। আজারবাইজান প্রকাশ্যে ভারতের শত্রু দেশ অর্থাৎ পাকিস্তানকে সমর্থন করে। আসুন, বুঝে নেওয়া যাক এই উত্তেজনা কেন এবং কীভাবে বাড়ল, এবং এর পেছনের কারণগুলি কী।

উত্তেজনার প্রধান কারণসমূহ
১. ইয়েকাতেরিনবার্গে আজারবাইজানি নাগরিকদের মৃত্যু: গত ২৭ জুন রাশিয়ার ইয়েকাতেরিনবার্গে রুশ পুলিশ আজারবাইজান বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযান চালায়। ২০০০-এর দশকের কিছু হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য এই অভিযান চালানো হয়েছিল, যেখানে আজারবাইজানি অপরাধী গোষ্ঠীর হাত ছিল বলে মনে করা হয়। এই সময় দুই আজারবাইজানি ভাই, হুসেন এবং জিয়াদদিন সাফারোভের হেফাজতে মৃত্যু হয়। আজারবাইজানের দাবি, এই দুজনকে রুশ পুলিশ নির্মমভাবে পিটিয়ে এবং নির্যাতন করে হত্যা করেছে। অন্যদিকে, রাশিয়া বলছে, একজনের মৃত্যু হৃদরোগে হয়েছে এবং দ্বিতীয় মৃত্যুর তদন্ত চলছে। আজারবাইজান এটিকে “ইচ্ছাকৃত হত্যা” এবং “নির্যাতন” আখ্যা দিয়েছে, যার পর উভয় দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

২. আজারবাইজানের পাল্টা পদক্ষেপ: রুশ সাংবাদিকদের গ্রেফতারি: এই ঘটনার জবাবে, আজারবাইজান বাকুতে রুশ সরকার পরিচালিত সংবাদমাধ্যম “স্পুটনিক আজারবাইজান”-এর দফতরে অভিযান চালায়। এই অভিযানে স্পুটনিকের দুই সিনিয়র সাংবাদিক ইগর কার্তাভিখ এবং ইয়েভজেনি বেলোউসোভ সহ সাত রুশ নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি, অবৈধ ব্যবসা এবং অর্থ পাচারের মতো অভিযোগ আনা হয়। এছাড়াও, প্রায় ১৫ জন অন্যান্য রুশ নাগরিককে মাদক পাচার এবং সাইবার অপরাধের অভিযোগে আটক করা হয়। রাশিয়া এই গ্রেফতারিগুলিকে “অনুপযুক্ত” এবং “প্রতিশোধমূলক” বলে আখ্যা দিয়েছে, যার ফলে বিবাদ আরও গভীর হয়েছে।

৩. বিমান দুর্ঘটনার পুরোনো বিবাদ: উত্তেজনার আরেকটি বড় কারণ হল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে একটি বিমান দুর্ঘটনা। আজারবাইজান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান, যেখানে ৬৭ জন আরোহী ছিলেন, রাশিয়ার গ্রোজনি শহরের কাছে বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় ৩৮ জন মারা যান। আজারবাইজানের দাবি, রুশ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভুল করে এই বিমানটিতে হামলা চালায়। আজারবাইজানি মিডিয়া সম্প্রতি কিছু অডিও রেকর্ডিং প্রকাশ করেছে, যেখানে কথিত রুশ সামরিক কর্মকর্তাদের বিমানটিতে গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে শোনা যায়। রাশিয়া এই দুর্ঘটনার দায় নিতে অস্বীকার করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেছেন, যা রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে।

৪. রুশ স্কুলগুলিতে নিষেধাজ্ঞা এবং সাংস্কৃতিক পদক্ষেপ: আজারবাইজান রাশিয়ার বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা দেশে রুশ ভাষার স্কুলগুলিকে ধীরে ধীরে বন্ধ করার ঘোষণা করেছে। আজারবাইজানে প্রায় ৩৪০টি রুশ ভাষার স্কুল রয়েছে, যেখানে দেড় লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এছাড়াও, আজারবাইজান রাশিয়া সম্পর্কিত সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করেছে এবং রুশ সংসদের সাথে পরিকল্পিত বৈঠকগুলিও স্থগিত করেছে। এই পদক্ষেপগুলি রাশিয়ার জন্য একটি বড় ধাক্কা, কারণ তারা দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে তাদের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে চায়।

উত্তেজনার পেছনের গভীর কারণসমূহ
এই তাৎক্ষণিক ঘটনাগুলি ছাড়াও, কিছু গভীর এবং দীর্ঘমেয়াদী কারণও রয়েছে, যা এই উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে:

আজারবাইজানের তুরস্কের সাথে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক: আজারবাইজান এবং তুরস্কের মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়েছে। তুরস্ক ২০২০ এবং ২০২৩ সালে আজারবাইজানকে নাগার্নো-কারাবাখ অঞ্চলে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক সমর্থন দিয়েছে, যার ফলে আজারবাইজানের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। রাশিয়া পূর্বে এই অঞ্চলে শান্তি রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে তাদের প্রভাব বজায় রাখত, এখন তাদের অবস্থান দুর্বল হতে দেখছে। ২০২৩ সালে রুশ শান্তি রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যাহারের পর রাশিয়ার প্রভাব আরও কমে গেছে। তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রাশিয়াকে অস্বস্তিতে ফেলছে, কারণ তারা দক্ষিণ ককেশাসকে তাদের প্রভাবাধীন অঞ্চল হিসেবে দেখে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব: রাশিয়ার মনোযোগ বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে কেন্দ্রীভূত, যার কারণে তারা দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে তাদের প্রভাব বজায় রাখতে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আজারবাইজান এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাদের নীতিগুলিকে আরও শক্তিশালী করেছে। উদাহরণস্বরূপ, আজারবাইজানি সরকারি টিভি চ্যানেল AZTV সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ব্যর্থতাগুলি তুলে ধরে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেছে, যা রাশিয়ার জন্য অপমানজনক ছিল। এছাড়াও, আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভোলোডোমির জেলেনস্কির সাথে ফোনে কথা বলেছেন। জেলেনস্কি আজারবাইজানকে “রাশিয়ার দাপটের বিরুদ্ধে সমর্থন”-এর আশ্বাস দিয়েছেন। এই আলোচনাকে রাশিয়ায় উস্কানিমূলক কূটনৈতিক ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *