ভারত-মার্কিন ১০ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তি, আসল সুবিধা কার ঘরে?

ভারত-মার্কিন ১০ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তি, আসল সুবিধা কার ঘরে?

ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও এক ধাপ এগিয়েছে। দুই দেশ আগামী ১০ বছরের জন্য একটি নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে সম্মত হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ এই চুক্তিকে আরও শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করেছেন। এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত এবং সামরিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতের কী লাভ হবে এবং আমেরিকা কী পাবে? আসুন, এটি বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।

ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস
ভারত ও আমেরিকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নতুন কিছু নয়। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, এই সম্পর্ক ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ থেকে শুরু হয়েছিল, যখন আমেরিকা ভারতকে সামরিক সহায়তা দিয়েছিল। এরপর ১৯৮৪ সালে প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়। ১৯৮৬ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব ক্যাসপার ওয়েনবার্গার ভারতে আসেন, যা কোনো মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের প্রথম ভারত সফর ছিল। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

১৯৯৫ সালে ‘এগ্রিড মিনিট অন ডিফেন্স রিলেশন’ নামে প্রথম আনুষ্ঠানিক নথি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ২০০২ সালে হাই-টেকনোলজি কোঅপারেশন গ্রুপ (HTCG) গঠিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল উচ্চ-প্রযুক্তিগত বিষয়ে আলোচনা করা। ২০০৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ‘নেক্সট স্টেপস ইন স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’ (NSSP) শুরু করেন। ২০০৫ সালে দুই দেশ ১০ বছরের প্রতিরক্ষা কাঠামোর ওপর স্বাক্ষর করে, যা এই সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তোলে।

সময়ের সাথে শক্তিশালী হয়েছে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক
সময়ের সাথে সাথে ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়েছে। ২০১০ সালে তৎকালীন মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিনটন এবং ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রী এস.এম. কৃষ্ণ আমেরিকা-ভারত কৌশলগত সংলাপ শুরু করেন। ২০১২ সালে ডিফেন্স টেকনোলজি অ্যান্ড ট্রেড ইনিশিয়েটিভ (DTTI) চালু হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এবং বাণিজ্য বাড়ানো। ২০১৫ সালে উভয় দেশ এশিয়া-প্রশান্ত এবং ভারত মহাসাগর অঞ্চলের জন্য একটি যৌথ কৌশলগত ভিশন প্রকাশ করে।

২০১৬ সালে আমেরিকা ভারতকে তাদের প্রধান প্রতিরক্ষা অংশীদার ঘোষণা করে। ২০১৮ সালে ভারতকে স্ট্র্যাটেজিক ট্রেড অথরাইজেশন টিয়ার-১ স্টেটসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার ফলে ভারত লাইসেন্স ছাড়াই আমেরিকা থেকে সামরিক এবং ডুয়াল-ইউজ প্রযুক্তি পেতে শুরু করে। একই বছর মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের নাম পরিবর্তন করে ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড করা হয়, যা ভারতের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত গুরুত্বের ইঙ্গিত দেয়।

২০১৯ সালে উভয় দেশ শিল্প নিরাপত্তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ২০২১ সালে ইন্দো-ইউএস শিল্প নিরাপত্তা যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০২৩ সালে ভারত-আমেরিকা কৌশলগত প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা শিল্প সহযোগিতার জন্য INDUS-X চালু করে। এছাড়াও, ভারত বাহরাইন-ভিত্তিক যৌথ সামুদ্রিক বাহিনীর পূর্ণ সদস্য হয়।

ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বেশ কয়েকটি মৌলিক চুক্তি হয়েছে, যা এই অংশীদারিত্বের ভিত্তি। ২০০২ সালে জেনারেল সিকিউরিটি অফ মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট (GSOMIA) স্বাক্ষরিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে গোপন সামরিক তথ্য সুরক্ষিত রাখা। ২০১৬ সালে লজিস্টিক্স এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অফ এগ্রিমেন্ট (LEMOA) স্বাক্ষরিত হয়, যা সামরিক সহায়তা এবং পরিষেবা প্রক্রিয়াকে সহজ করে।

২০১৮ সালে কমিউনিকেশন কম্প্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট (COMCASA) হয়, যা ভারতকে আমেরিকার উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার দেয়। ২০২০ সালে বেসিক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট (BECA) স্বাক্ষরিত হয়, যা ভূ-স্থানিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে। এই সব চুক্তি দুই দেশের মধ্যে সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা আরও শক্তিশালী করে।

২০০৮ সালের পর প্রতিরক্ষা বাণিজ্যে বিশাল পরিবর্তন
২০০৮ সালের আগে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে প্রতিরক্ষা বাণিজ্য সীমিত ছিল। সে সময় আমেরিকা ভারতকে কিছু নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার, কাউন্টারব্যাটারি রাডার এবং একটি পরিবহন ডক শিপ সরবরাহ করে, যার মোট মূল্য প্রায় ২৩৩ মিলিয়ন ডলার ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের পর প্রতিরক্ষা চুক্তিতে ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে। ভারত আমেরিকা থেকে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে।

এই চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে C-17 গ্লোবমাস্টার হেভি ট্রান্সপোর্ট বিমান, P-8I পোসেইডন সামুদ্রিক টহল বিমান, অ্যাপাচি এবং চিনুক হেলিকপ্টার, হারপুন অ্যান্টি-শিপ ক্ষেপণাস্ত্র, M-777 হাউইটজার কামান এবং MQ-9B ড্রোন। আমেরিকা ছাড়া অন্য যেকোনো দেশের মধ্যে ভারত এখন C-17 এবং P-8I বিমানের বৃহত্তম অপারেটর।

সম্প্রতি অক্টোবর ২০২৪-এ ভারত মার্কিন সংস্থা জেনারেল অ্যাটমিকস থেকে ৩১টি MQ-9B ড্রোন কেনার চুক্তি করেছে, যার মূল্য প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৫টি সি গার্ডিয়ান ড্রোন নৌবাহিনীর জন্য এবং ১৬টি স্কাই গার্ডিয়ান ড্রোন সেনা ও বিমানবাহিনীর জন্য থাকবে। এই ড্রোনগুলো ভারতের সমুদ্র এবং স্থল সীমান্তের নজরদারি ও সুরক্ষায় বড় ভূমিকা পালন করবে।

ভারতের জন্য কী লাভ?
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো এই ১০ বছরের চুক্তি থেকে ভারতের কী লাভ হবে? এর উত্তর হলো, অনেক ধরনের লাভ হবে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ভারতের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে। MQ-9B ড্রোন, P-8I বিমান, অ্যাপাচি হেলিকপ্টার এবং জাভলিন অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইলের মতো অস্ত্রগুলো ভারতের সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করবে। বিশেষ করে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় এই অস্ত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *