১০ বছরের ছেলে লাঠিচার্জ থেকে বাঁচতে গঙ্গায় ঝাঁপিয়েছিল, সেখানেই জিতল সাঁতার প্রতিযোগিতা, হয়ে উঠল দেশের ‘হিরো’

জীবনে কখন কী ঘটবে, তা কেউ জানে না। উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর ১০ বছর বয়সী শচীন নাগ-এর সাথেও এমনই কিছু ঘটেছিল, যে লাঠিচার্জ থেকে বাঁচতে গঙ্গা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল এবং এখান থেকেই তার জীবন বদলে যায়। এই ছোট ছেলেটি পরবর্তীতে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সাঁতারু হয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছিল।
এক অসাধারণ জীবনের গল্প
শচীন নাগ ১৯২০ সালের ৫ জুলাই বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন। গঙ্গা নদীর তীরে বারাণসীতে জন্ম হওয়ায় সাঁতারের প্রতি তার প্রবণতা ছিল, কিন্তু এই খেলায় তার আসাটা ছিল শুধুই এক কাকতালীয় ঘটনা। একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বারাণসীর গঙ্গা ঘাটে একটি জনসভা ছিল। এই সমাবেশে ১০ বছর বয়সী শচীনও উপস্থিত ছিলেন। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা যখন ভিড়ের উপর লাঠিচার্জ শুরু করেন, তখন ১০ বছর বয়সী শচীন নিজেকে বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দেন এবং দ্রুত সাঁতার কাটতে শুরু করেন। কাকতালীয়ভাবে, সেই সময় নদীতে একটি সাঁতার প্রতিযোগিতা চলছিল। শচীন সাঁতারুদের সারিতে ছিলেন।
১০ কিলোমিটারের প্রতিযোগিতা শেষ হলে শচীন তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। এটি এমন একজন সাঁতারুর ক্যারিয়ারের শুরু ছিল যিনি পরবর্তীতে দেশের নাম উজ্জ্বল করতে চলেছিলেন।
১৯৩০ থেকে ১৯৩৬ সালের মধ্যে শচীন নাগ অসংখ্য স্থানীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং শীর্ষ দুই স্থানে নিজের জায়গা করে নেন। তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিখ্যাত সাঁতার কোচ যামিনী দাস তাকে কলকাতায় ডেকে নেন এবং উচ্চস্তরে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। বাংলার হাটখোলা ক্লাবের হয়ে শচীন রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে শুরু করেন।
১৯৩৮ সালে ১০০ মিটার এবং ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতারে তিনি জয়লাভ করেন। ১৯৩৯ সালে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের জাতীয় রেকর্ডের সমতা অর্জন করেন এবং ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল ইভেন্টে নতুন রেকর্ড গড়েন। ১৯৪০ সালে, নাগ সহ-সাঁতারু দিলীপ মিত্রের করা ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রেকর্ড ভেঙে দেন। তিনি টানা ৯ বছর রাজ্যস্তরে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতার প্রতিযোগিতার বিজয়ী ছিলেন।
শচীন নাগ ১৯৪৮ সালের অলিম্পিকে অংশ নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ১৯৪৭ সালে প্রশিক্ষণ থেকে ফেরার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। ডাক্তাররা তাকে পরবর্তী দুই বছর সাঁতার থেকে দূরে থাকতে বলেন। নাগ অলিম্পিকে যাওয়ার সুযোগ হারাতে চাননি, তাই ৬ মাসের কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি প্রস্তুত হয়ে যান। যদিও অলিম্পিকের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা তার জন্য কঠিন ছিল, তিনি বিভিন্ন স্থানে ঘুরে তহবিল সংগ্রহ করেন। সে সময়ের প্রখ্যাত গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তার জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। এর ফলস্বরূপ, তিনি ১৯৪৮ সালের অলিম্পিকে অংশ নেন এবং ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন।
শচীন নাগের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন আসে ১৯৫১ সালের ৮ মার্চ। নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে তিনি ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে স্বর্ণপদক জেতেন। দর্শক সারিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও উপস্থিত ছিলেন। নেহরু নাগের পারফরম্যান্সে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। তিনি তখনই নাগকে আলিঙ্গন করেন এবং নিজের পকেট থেকে গোলাপ ফুল বের করে তাকে দেন। ১৯৫১ সালের এশিয়ান গেমসে নাগ ৪×১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলে এবং ৩×১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেতে ব্রোঞ্জ পদকও জিতেছিলেন।
শচীন ১৯৫২ সালের অলিম্পিকেও ভারতীয় দলের অংশ ছিলেন।
একজন সফল সাঁতারু এবং দেশের জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে পদক জেতার পরেও শচীন নাগ সারা জীবন আর্থিক সমস্যায় ভুগেছেন। ১৯৮৭ সালের ১৯ আগস্ট ৬৭ বছর বয়সে তার জীবনাবসান হয়।