সময়ের আগে আসা গরম অর্থনীতিকে এমনভাবে ক্ষতি করতে পারে

ভারতের আবহাওয়া সংস্থার পরিসংখ্যান দেখায় যে ফেব্রুয়ারি মাসটি গত ১২৫ বছরে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ ছিল।
শীতের সময় কমে যাওয়া নিতিন গোয়েলের ব্যবসাকে বিপদের মুখে ফেলেছে।
গত ৫০ বছর ধরে তার পরিবার লুধিয়ানায় পোশাকের ব্যবসা চালিয়ে আসছে। গোয়েলের পরিবার জ্যাকেট ও সোয়েটারের মতো শীতের পোশাকের ব্যবসা করে।
কিন্তু এ বছর গরম আগে চলে এসেছে। এর ফলে তার কো ম্পা নিকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
এখন তাকে তার ব্যবসায়িক কৌশলেও পরিবর্তন আনতে হচ্ছে।
আবহাওয়া-সংক্রান্ত এই চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে নিতিন গোয়েল বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, “প্রতি বছর শীতের সময়কাল কমে যাচ্ছে। আমাদের সোয়েটারের পরিবর্তে টি-শার্ট তৈরি করতে শুরু করতে হয়েছে। গত পাঁচ বছরে আমাদের বিক্রি অর্ধেক হয়ে গেছে। এই মৌসুমে তা আরও ১০ শতাংশ কমেছে।”
দেশজুড়ে শীতের সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ায় কৃষি ও কলকারখানায় উদ্বেগ বেড়েছে। এর ফলে ফসলের ধরন ও ব্যবসায়িক পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসছে।
নিতিন গোয়েল
শীতের পোশাক প্রস্তুতকারীরা বলছেন যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে খুচরা বিক্রেতারা নিশ্চিত অর্ডার গ্রহণ করতেও দ্বিধাবোধ করছেন।
ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এই বছর ফেব্রুয়ারি মাস ছিল গত ১২৫ বছরে ভারতের সবচেয়ে উষ্ণতম।
দেশের বিভিন্ন অংশে সাপ্তাহিক গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।
আবহাওয়া দপ্তর সতর্ক করেছে যে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে দেশের অনেক অঞ্চলে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে এবং গরম বাতাস প্রবাহিত হতে পারে।
নিতিন গোয়েলের মতো ব্যবসায়ীদের জন্য এই অনিয়মিত আবহাওয়া শুধু পণ্যের বিক্রি কমার কারণ নয়, বরং এর চেয়েও বেশি কিছু।
তিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ব্যবসায়িক মডেল গড়ে তুলেছিলেন, কিন্তু অনিয়মিত আবহাওয়ার কারণে তাকে পুরো ব্যবসায়িক কাঠামো বদলাতে হচ্ছে।
গোয়েলের কো ম্পা নি দেশজুড়ে মাল্টি-ব্র্যান্ড আউটলেটগুলিতে পোশাক সরবরাহ করে। তিনি জানান যে এই আউটলেটগুলি এখন পণ্য সরবরাহের পরপরই অর্থ পরিশোধ করছে না।
পরিবর্তে তারা ‘বিক্রি বা ফেরত’ মডেল অনুসরণ করছে। এই মডেলে যেসব পণ্য বিক্রি হয় না, সেগুলো কো ম্পা নিকে ফেরত পাঠানো হয়। ফলে সম্পূর্ণ ঝুঁকি প্রস্তুতকারকদের উপর চলে আসে।
এ কারণে এ বছর তাকে তার গ্রাহকদের বড় ছাড় এবং প্রণোদনা দিতে হয়েছে।
গোয়েল বলেন, “বড় খুচরা বিক্রেতারা তাদের নিশ্চিত অর্ডার থাকা সত্ত্বেও পণ্য গ্রহণ করেননি।”
ফলে লুধিয়ানার কিছু ছোট ব্যবসায়ী তাদের দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
Getty Images
গরমের কারণে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় আলফানসো আমের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।
প্রায় ১২০০ মাইল দূরে, ভারতের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত দেবগড় শহরে গরম ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় আম আলফানসোর বাগানগুলিকে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন করেছে।
কৃষক বিদ্যাধর জোশী ১,৫০০টি গাছের মালিক।
তিনি জানান, “এ বছর উৎপাদন স্বাভাবিক ফলনের মাত্র ৩০ শতাংশ হবে।”
এই অঞ্চল থেকে রপ্তানিকৃত আলফানসো আম অত্যন্ত মিষ্টি ও সুগন্ধিযুক্ত ফল। এটি প্রধানত মহারাষ্ট্রের রায়গড়, সিন্ধুদুর্গ ও রত্নাগিরি জেলায় চাষ করা হয়।
এ বছর এর উৎপাদন কমে গেছে।
জোশী বলেন, “এ বছর আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারি। কারণ, ফসল বাঁচানোর জন্য আমাদের সেচ ও সার বাবদ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খরচ করতে হয়েছে।”
তিনি জানান যে এই অঞ্চলের অনেক কৃষক তাদের আমের বাগানে কাজ করা নেপালি শ্রমিকদের ফেরত পাঠাচ্ছেন, কারণ তাদের জন্য আর তেমন কাজ নেই।
BBC
দ্রুত আসা গরমের কারণে গম ও ছোলার ফসলও ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
তবে, দেশের কৃষিমন্ত্রী নিম্নমানের ফসল উৎপাদনের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন এবং ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে এ বছর ভারতে রেকর্ড পরিমাণ গম উৎপাদন হবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা তেমনটা আশা করছেন না।
কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার থিংক ট্যাঙ্কের অভিষেক জৈন বলেন, “২০২২ সালে গরম বাতাসের কারণে ফসলের উৎপাদন ১৫-২৫ শতাংশ কমেছিল। এ বছরও একই অবস্থা হতে পারে।”
বিশ্বে গম উৎপাদনে ভারত দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তবে এই সমস্যাগুলোর কারণে ভারতকে ব্যয়বহুল আমদানির উপর নির্ভর করতে হতে পারে।
২০২২ সালে গম রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, যা দীর্ঘমেয়াদে বহাল থাকতে পারে।
Getty Images
শীতের সময় কমে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অর্থনীতিবিদরাও কৃষির জন্য জলের প্রাপ্যতার উপর বাড়তে থাকা তাপমাত্রার প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন।
সিইইডব্লিউ অনুযায়ী, উত্তর ভারতের জলাশয়গুলির স্তর তাদের ক্ষমতার মাত্র ২৮ শতাংশে নেমে গেছে।
গত বছর এটি ৩৭ শতাংশ ছিল।
এর প্রভাব ফল-সবজি ও দুগ্ধ শিল্পেও পড়তে পারে। ইতোমধ্যে দেশের কিছু অঞ্চলে দুধের উৎপাদন ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
ব্যাংক অফ বরোদার প্রধান অর্থনীতিবিদ মদন সবনভিস বলেন, “এসব কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং RBI-এর ৪ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সমস্যা হতে পারে।”
ভারতে খাদ্যপণ্যের দাম কয়েক মাস ধরে উচ্চ থাকার পর অবশেষে কমতে শুরু করেছে। এর ফলে সুদের হারে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত কাটছাঁট হয়েছে।
সিইইডব্লিউ বলছে যে ঘন ঘন আসা তাপপ্রবাহের প্রভাব কমাতে অবিলম্বে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
এর মধ্যে রয়েছে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য উন্নত পরিকাঠামো, ফসলের বীমা, এবং জলবায়ু মডেলের সঙ্গে ফসলের ক্যালেন্ডার তৈরি করা।
একটি প্রধান কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে ভারত জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে বিশেষভাবে সংবেদনশীল।
সিইইডব্লিউ অনুমান করে যে ভারতের প্রতি চারটি জেলার মধ্যে তিনটিতে ‘গুরুতর আবহাওয়ার পরিবর্তন’ লক্ষ্য করা গেছে।
এর মধ্যে ৪০ শতাংশ এলাকা এমন, যেখানে আবহাওয়ার ‘অদলবদল প্যাটার্ন’ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ, যেখানে অতীতে বন্যা হতো, সেখানে এখন বেশি খরা দেখা দিচ্ছে।
একটি অনুমান অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে গরমের কারণে দেশে প্রায় ৫.৮ শতাংশ দৈনিক কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে।
যদি অবিলম্বে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ভারত এমন এক ভবিষ্যতের সম্মুখীন হতে পারে যেখানে তাপপ্রবাহ জীবন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠবে।