পাকিস্তানে ট্রেন হাইজ্যাক: ২০০-র বেশি কফিন কোয়েটা স্টেশনে পৌঁছেছে, ২৭ জঙ্গি নিহত

পাকিস্তানে জাফর এক্সপ্রেস দখলকারী বালুচ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান চলছে। তবে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে কোনো সরকারি ঘোষণা দেওয়া হয়নি। তবে রেল কর্মকর্তাদের মতে, বুধবার কোয়েটা রেলওয়ে স্টেশন থেকে উদ্ধারকারী ট্রেনে ২০০-র বেশি কফিন বোলানে পাঠানো হচ্ছে।
একজন রেলওয়ে কর্মকর্তা বিবিসির প্রতিবেদক মুহাম্মদ কাসিমকে বলেছেন যে বোলানের জন্য একটি উদ্ধারকারী ট্রেন পাঠানো হচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকবে।
অন্য একজন কর্মকর্তা বিবিসির মালিক মুদাসসরের সঙ্গে কথা বলার সময় বলেছেন যে প্রশাসন ইতোমধ্যেই ৯০টি খালি কফিন প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছে, যা একই ট্রেনে পাঠানো হবে, এবং ট্রেন ছাড়ার আগে আরও ১৩০টি কফিন ট্রেনে রাখা হবে।
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে মঙ্গলবার চার শতাধিক যাত্রী বহনকারী একটি ট্রেনে অস্ত্রধারী জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে সেটি দখল করে নেয়।
১৫৫ যাত্রীকে উদ্ধারের দাবি
সেনা সূত্রের দাবি, এখন পর্যন্ত ১৫৫ জন যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে।
বালুচ বিদ্রোহীদের হামলা চালানোর ২২ ঘণ্টারও বেশি সময় কেটে গেছে।
সেনা সূত্র অনুযায়ী, ১৫৫ জন যাত্রীকে মুক্ত করা হয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে ২৭ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে। তবে এখনো বহু যাত্রী জিম্মি রয়েছে।
তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রিয়জনদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
এই যাত্রীদের মধ্যে থাকা এজাজের আত্মীয় লুবনা বুধবার বিবিসিকে জানান যে তার দুলাভাই জাফর এক্সপ্রেসের যাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন।
লুবনা জানান, তিনি তার দুলাভাই সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়ার আশায় মঙ্গলবার রাত থেকে রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করছেন, তবে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য পাননি।
তিনি বলেন, “যদি জাফর এক্সপ্রেসের ওপর হামলার ঝুঁকি ছিল, তবে ট্রেনটি চালানো হলো কেন? এই ট্রেনে সৈন্যরা ছিল, তাহলে এত বড় ঝুঁকি নেওয়া হলো কেন? আমাদের পরিবারের জীবনের সঙ্গে কেন খেলা করা হলো?”
বেশ কয়েকজন যাত্রীর পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন যে প্রশাসন তাদের কোনো তথ্য দিচ্ছে না।
হামলার দায় স্বীকার করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। হামলাটি কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেসে ঘটেছিল।
এদিকে, জাফর এক্সপ্রেসের ৮০ জন যাত্রী মাচ রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছেছে, যেখানে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
রেলওয়ে কর্মকর্তাদের মতে, এই ট্রেনে ৯টি বগি ছিল এবং এতে ৪০০-র বেশি যাত্রী ছিল।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তালাল চৌধুরী বলেছেন যে, জাফর এক্সপ্রেসের বেশ কয়েকজন যাত্রীকে ট্রেন থেকে নামিয়ে জঙ্গিরা পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে গেছে।
বালুচ লিবারেশন আর্মির হুমকি
বেলুচিস্তান সরকারের এক মুখপাত্র ডন নিউজপেপারকে জানিয়েছেন, ট্রেনে ভারী গুলিবর্ষণও হয়েছে।
বালুচ লিবারেশন আর্মি দাবি করেছে যে, ট্রেনে থাকা বেশ কয়েকজন যাত্রী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য তাদের দখলে রয়েছে এবং যদি তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে এর গুরুতর পরিণতি হবে।
কোয়েটার একজন সিনিয়র রেল কর্মকর্তা মুহাম্মদ কাশিফ জানিয়েছেন, ট্রেনটিতে ৪০০ থেকে ৫০০ যাত্রী ছিলেন।
রেলওয়ে নিরাপত্তা কর্মকর্তা জিয়া কাকার জানিয়েছেন, যেহেতু এলাকায় নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে ট্রেনের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সরকারি মুখপাত্র জানিয়েছেন, সিব্বি হাসপাতালে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে এবং ঘটনাস্থলে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়েছে।
কোয়েটার জেলা হাসপাতালের মুখপাত্র ড. ওয়াসিম বেগ বিবিসিকে জানিয়েছেন যে সিব্বি ও কোয়েটার প্রধান হাসপাতালগুলিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে এবং চিকিৎসা কর্মীদের আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “সিব্বি হাসপাতালে ১০০ জন রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে, তবে গুরুতর আহতদের কোয়েটায় পাঠানো হবে।”
জাফর এক্সপ্রেসের যাত্রীদের পরিবারের সদস্যরা কোয়েটা রেলওয়ে স্টেশনের কাউন্টারে গিয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করছেন।
আজ সকালে কোয়েটা থেকে লাহোরগামী যাত্রী মুহাম্মদ আশরাফের ছেলে বিবিসিকে জানান, “দুপুর ২টা থেকে আমার বাবা সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না।”
বালুচ লিবারেশন আর্মি কী চায়?
বালুচিস্তানের মানুষ মনে করেন যে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের সময় তাদের জোরপূর্বক পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল, যখন তারা নিজেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিল।
এই কারণে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তাদের বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এবং এখনো চলছে।
বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা দাবিকারী বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)।
বলা হয় যে, এই সংগঠন প্রথম ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে গঠিত হয়।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকারের বিরুদ্ধে বেলুচরা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। কিন্তু সামরিক শাসক জিয়াউল হক ক্ষমতা গ্রহণের পর বেলুচ জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয় এবং এর ফলে বিদ্রোহ কমে যায় এবং বিএলএ অদৃশ্য হয়ে যায়।
এরপর ২০০০ সালে আবার সক্রিয় হয়।
২০০০ সাল থেকে সংগঠনটি বেলুচিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে আসছে।
সংগঠনের বেশিরভাগ সদস্য মারি ও বুগতি উপজাতির অন্তর্ভুক্ত এবং তারা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
বালুচিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সরদার আকবর খান বুগতি বিএলএ-এর অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর এক অভিযানে তিনি নিহত হন।
এরপর, বিএলএ-এর নেতৃত্ব দেয় নওয়াবজাদা বালাচ মিরি। ২০০৭ সালের নভেম্বরে তার মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়।
২০০৬ সালে পাকিস্তান সরকার বিএলএ-কে একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
এই সংগঠন বেলুচিস্তানকে বিদেশি প্রভাব, বিশেষ করে চীন ও পাকিস্তানি সরকারের কাছ থেকে মুক্ত করতে চায়।
বিএলএ মনে করে যে বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রথম অধিকার তাদের এবং পাকিস্তান সরকার সেগুলো শোষণ করছে।