সেনা বিভাজনের সময় স্বাধীনতার সময় কীভাবে ঘটেছিল? ভারত কত সৈন্য পেল এবং কতজন পাকিস্তানে গেল?

সেনা বিভাজনের সময় স্বাধীনতার সময় কীভাবে ঘটেছিল? ভারত কত সৈন্য পেল এবং কতজন পাকিস্তানে গেল?

ভারতের স্বাধীনতার দীর্ঘ লড়াই ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ থেকে শুরু হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) পরবর্তী সময়ে আরও তীব্র হয়ে ওঠে। যুদ্ধের সময় ভারতীয়দের অবদানের বিনিময়ে স্বশাসনের আশা বৃদ্ধি পায়।

১৯৪৫ সালে নির্বাচিত নতুন ব্রিটিশ সরকার অবশেষে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আশা করেছিল যে তারা একটি অখণ্ড ভারত রেখে যাবে, তবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নবগঠিত জাতির কাঠামো নিয়ে একমত হতে পারেনি।

বিভাজন প্রক্রিয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত

১৯৪৬ সালে আরেকটি ব্যর্থ সম্মেলনের পরে, মুসলিম লীগের নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ একটি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য সরাসরি সংগ্রাম শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত, ব্রিটিশদের কাছে ভারতের বিভাজন ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন ২ জুন ১৯৪৭ সালে ঘোষণা করেন যে ভারতকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানে বিভক্ত করা হবে। এতে দুটি ভৌগোলিকভাবে পৃথক অংশ থাকবে—পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) এবং পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)।

ভারতীয় সেনার বিভাজন

বিভাজনের ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনীতেও বিভক্তি সৃষ্টি হয়। লর্ড মাউন্টব্যাটেন সেনাবাহিনীর বিভাজনের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি জিন্নাহকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে ভারতীয় সেনাবাহিনী একজন ব্রিটিশ কমান্ডারের অধীনে থাকা উচিত, যিনি ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ের জন্য দায়ী হবেন। তবে, জিন্নাহ সঙ্গে সঙ্গে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং সেনাবাহিনীর বিভাজনের ওপর জোর দেন।

স্বাধীনতার তারিখ ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ নির্ধারিত হয় এবং ব্রিটিশ সেনাদের তাদের ছাউনিতে ফিরে যেতে বলা হয়। ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার সাইরিল র‍্যাডক্লিফকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভাঙনের আদেশ জারি করা হয় এবং এতে ফিল্ড মার্শাল ক্লড অকিনলেক এবং মেজর জেনারেল রেজিনাল্ড সেভরির স্বাক্ষর ছিল।

সেনাবাহিনীর ইউনিট বিভাজন

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈন্যদের ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যে একটি দেশ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তবে একটি শর্ত ছিল। এইচ. এম. প্যাটেলের বই ‘রাইটস অফ প্যাসেজ’ অনুসারে, পাকিস্তানের কোনো মুসলিম ভারতীয় সেনায় এবং ভারতের কোনো হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবে না।

ব্রিটিশ ন্যাশনাল আর্মি মিউজিয়ামের রিপোর্ট অনুসারে, বিভাজনের পরে দুই-তৃতীয়াংশ সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীতে থাকেন এবং এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তানে যান। ভারত ২,৬০,০০০ সৈন্য পায়, আর পাকিস্তান ১,৩১,০০০ সৈন্য পায়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই মুসলিম ছিলেন। নেপালের গুর্খা ব্রিগেডকে ভারত এবং ব্রিটেনের মধ্যে ভাগ করা হয়।

বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর বিভাজন

ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে বিমান বাহিনীতে ১৩,০০০ সৈন্য ছিল। এর মধ্যে ১০,০০০ ভারত পায় এবং ৩,০০০ পাকিস্তান পায়। নৌবাহিনীতে ৮,৭০০ সৈন্য ছিল, যার মধ্যে ৫,৭০০ ভারত এবং ৩,০০০ পাকিস্তানে যায়। কিছু ব্রিটিশ কর্মকর্তা এই পরিবর্তনের সময় ভারতে থেকে সাহায্য করেছিলেন। এদের মধ্যে ভারতের প্রথম সেনা প্রধান জেনারেল স্যার রবার্ট লকহার্ট এবং পাকিস্তানের প্রথম সেনা প্রধান জেনারেল স্যার ফ্রাঙ্ক মেসারভি ছিলেন।

স্বাধীনতার পরে ব্রিটিশ রেজিমেন্টের প্রত্যাবর্তন

স্বাধীনতার পরে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রেজিমেন্টগুলোকে ধীরে ধীরে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উপজাতীয় এলাকা থেকে পরিকল্পিত এবং সংগঠিতভাবে প্রত্যাহার করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে প্রথম ব্যাটালিয়ন, সমারসেট লাইট ইনফ্যান্ট্রি (প্রিন্স অ্যালবার্ট) ভারত ছেড়ে যাওয়া শেষ ব্রিটিশ সামরিক ইউনিট ছিল। এটি ব্রিটেনের বৈশ্বিক সামরিক সক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, কারণ তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর শক্তি হারিয়েছিল।

স্বাধীনতার পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থা

বিভাজনের আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ৩৬% মুসলমান ছিল, তবে বিভাজনের পরে এই সংখ্যা কমে মাত্র ২% হয়ে যায়। মাত্র ৫৫৪ জন মুসলিম কর্মকর্তা ভারতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ উসমান, ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ আনিস আহমদ খান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইনায়াত হাবিবুল্লাহর মতো কিছু কর্মকর্তা ভারতকে তাদের মাতৃভূমি হিসাবে গ্রহণ করেন।

ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম এবং এর ফলে ঘটে যাওয়া বিভাজন ইতিহাসে এক অমোচনীয় ছাপ রেখে গেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল, হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, এবং উভয় দেশই তাদের নতুন স্বাধীনতার মূল্য চূড়ান্ত কষ্টের মাধ্যমে প্রদান করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *