এই গাছগুলি ব্রিটিশ সরকার ভারতে রোপণ করেছিল, এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, ভূগর্ভস্থ জল শোষণ করছে, গবেষণায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য

ভারতে সকল ধরণের গাছপালা প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, কিন্তু কিছু গাছপালা নীরবে আমাদের জমি এবং জল ধ্বংস করছে। এরকম একটি গাছ হল বিলায়তি কিকর (প্রোসোপিস জুলিফ্লোরা)। ১৮৫০-এর দশকে ব্রিটিশ সরকার এটি ভারতে নিয়ে আসে।
তার লক্ষ্য ছিল মরুকরণ বন্ধ করা এবং জমিকে উর্বর করা, কিন্তু বাস্তবতা ছিল বিপরীত। আজ এই গাছটি ভারতের অনেক রাজ্যে বিপজ্জনক আগাছার মতো ছড়িয়ে পড়েছে এবং এর কারণে কৃষকদের সমস্যা বাড়ছে।
বিদেশী কিকর গাছ ভারতে কীভাবে এলো?
আসলে এই গাছের শিকড় মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার সাথে যুক্ত। মরুভূমির সম্প্রসারণ রোধ করার জন্য এটি প্রথমে রাজস্থান এবং গুজরাটে রোপণ করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই গাছটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং এখন সারা দেশে ‘বিপজ্জনক পর্যায়ে’ ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ ভাষায় একে বিলয়াতি বাবুলও বলা হয়।
কেন বলা হচ্ছে যে এটি ক্ষতিকারক?
সম্প্রতি, সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যের জিলটস হিল ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারে পরিচালিত একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে বিদেশী কিকার ভারতীয় কৃষক, মাটি এবং জল সম্পদের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই গবেষণায় দেখা গেছে যে এই গাছটি:
মাটি থেকে অতিরিক্ত জল শোষণ করে: এটি চারপাশের মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে জল টেনে নেয়, যা অন্যান্য উদ্ভিদের জন্য কোনও আর্দ্রতা রাখে না।
ভূগর্ভস্থ জলস্তর কমছে: যেসব এলাকায় এই গাছটি প্রচুর পরিমাণে ছড়িয়ে আছে, সেখানে জলের উৎস ৪০ থেকে ৯০ ফুট নিচে নেমে গেছে। অনেক এলাকায় কূপগুলি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে।
কৃষি জমির ক্ষতি: এই গাছের কারণে ফসল শুকিয়ে যাচ্ছে, এবং কৃষকরা তীব্র জল সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে।
স্থানীয় গাছপালা ধ্বংস করে: এই গাছটি নিম এবং খেজরির মতো অন্যান্য স্থানীয় উদ্ভিদের জন্য কোনও জায়গা রাখে না। এটি তাদের বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
বিশ্ব উষ্ণায়নের সাথে সাথে এটি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে: গবেষণায় দেখা গেছে যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই গাছটি আরও বেশি জল টেনে নিতে শুরু করবে, যার অর্থ জল সংকট আরও গুরুতর হয়ে উঠতে পারে।
পিডিএফ দেখুন
কৃষকদের অসুবিধা এবং সরকারের উদাসীনতা
এই গাছটি ভারতের অনেক রাজ্যে যেমন রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ুতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষকদের ফসল শুকিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সরকার এ বিষয়ে বিশেষ কোনও মনোযোগ দিচ্ছে না। অনেক কৃষক বুঝতে পারছেন না কেন তাদের জলের উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে। যখন তারা কারণটা বুঝতে পারে, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।
বিজ্ঞানীরা কী বলছেন?
এই গবেষণার প্রধান বিজ্ঞানী, অধ্যাপক ড. মহারাজ পণ্ডিত aajtak.in কে বলেন যে এই গাছের কারণে কৃষকদের অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে, কিন্তু এ দিকে কোনও মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সরকারের উচিত এই সমস্যাটি গভীরভাবে তদন্ত করা এবং এই গাছের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া। গবেষণায় জড়িত আরেক বিজ্ঞানী, ওপি জিন্দাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ কুমার মনীশ বলেছেন যে অনেক গবেষণায় নিশ্চিত করা হয়েছে যে বিদেশী কিকর গাছ মাটির আর্দ্রতা দূর করে এবং আশেপাশের পরিবেশকে অনুর্বর করে তোলে।
এই গাছটি এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে
বাতাস এবং পাখির মাধ্যমে: এর বীজ বাতাসে উড়ে অথবা পাখির বিষ্ঠার মাধ্যমে সহজেই বহুদূরে ছড়িয়ে পড়ে।
শুষ্ক এবং অনুর্বর জমিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে: এটি কম বৃষ্টিপাত হয় এমন এলাকায় সবচেয়ে ভালো জন্মে।
গভীর এবং শক্তিশালী শিকড়: এর শিকড় এত শক্তিশালী যে এটি খুব দ্রুত মাটি থেকে আর্দ্রতা শোষণ করে।
বিজ্ঞানীরা একটি সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন
বিলায়তি কিকর অপসারণ: সরকারের উচিত এই গাছটি ব্যাপকভাবে নির্মূল করার পরিকল্পনা করা। এটি অপসারণ করা উচিত এবং এর জায়গায় নিম এবং খেজারির মতো দেশীয় গাছ লাগানো উচিত।
কৃষকদের সচেতন করা: কৃষকদের এর অসুবিধাগুলি সম্পর্কে অবহিত করা উচিত, যাতে তারা নিজেরাই এটি দূর করার উদ্যোগ নেয়।
সরকারি নীতি: কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত এই দিকে একটি জাতীয় স্তরের মিশন পরিচালনা করা যাতে জলের অপচয় বন্ধ করা যায়।
স্থানীয় গাছপালা ও উদ্ভিদের প্রচার: নিম, খেজরি এবং অন্যান্য স্থানীয় গাছপালা অনুর্বর এলাকায় রোপণ করা উচিত যাতে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে।
গুজরাটের বান্নি তৃণভূমি বিপদের মুখে
প্রো. পণ্ডিত তার গবেষণায় গুজরাটের বান্নি তৃণভূমির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন যে বিদেশী কিকর গাছের কারণে এই এলাকার সমগ্র বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে। যদি এটি শীঘ্রই বন্ধ না করা হয়, তাহলে অনেক স্থানীয় পাখির প্রজাতি এবং অন্যান্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বিদেশী কিকার নীরব জল চোরের মতো ভারতের মাটি এবং জল ধ্বংস করছে। এটি কেবল কৃষকদের জন্যই হুমকি নয়, বরং সমগ্র দেশের জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্রের জন্যও বিপজ্জনক প্রমাণিত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, যদি শীঘ্রই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে ভারতের অনেক অংশই অনুর্বর হয়ে পড়তে পারে।