মহাকাশে ধরা পড়ল ‘আইনস্টাইন রিং’: বিস্ময়ে মুগ্ধ বিজ্ঞানীরা

নয়াদিল্লি, ৩০ মার্চ ২০২৫: রাতের আকাশ যে শুধু সৌন্দর্যের নয়, বিস্ময়েরও ভাণ্ডার, তা আরও একবার প্রমাণিত হল। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের লেন্সে এবার ধরা পড়েছে ‘আইনস্টাইন রিং’—একটি বিরল মহাজাগতিক ঘটনা, যা দেখতে চোখের মতো একটি আলোকবৃত্ত। এই দৃশ্যের পেছনে রয়েছে দুটি ছায়াপথের আলোর বিকৃতি, যা বিজ্ঞানীদের কাছে শুধু চোখ ধাঁধানো দৃশ্যই নয়, মহাবিশ্বের গভীর রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠিও।
কী এই ‘আইনস্টাইন রিং’?
‘আইনস্টাইন রিং’ কোনও সাধারণ আলোকচ্ছটা নয়। এটি তৈরি হয় যখন কোনও বৃহৎ মহাজাগতিক বস্তু—যেমন একটি ছায়াপথ বা তারকাগুচ্ছ—তার পেছনে থাকা আরেকটি ছায়াপথ থেকে আসা আলোকে বাঁকিয়ে দেয়। এই ঘটনা আলবার্ট আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। তত্ত্ব অনুযায়ী, বৃহৎ ভরের বস্তু মহাকাশ-কালকে বিকৃত করে, ফলে আলো সোজা পথে না এসে বাঁকা পথে আমাদের কাছে পৌঁছায়। এই বিরল দৃশ্য গত ২৭ মার্চ কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিএসএ) এবং ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) প্রকাশ করেছে।
ছবিটি তুলেছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের অত্যাধুনিক ইনফ্রারেড ক্যামেরা। এতে সহযোগিতা করেছে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের অ্যাডভান্সড ক্যামেরা ফর সার্ভে এবং ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা ৩। ফলাফল? একটি নিখুঁত বৃত্তাকার আলোকচ্ছটা, যা দেখে বিজ্ঞানীরা উচ্ছ্বসিত।
কেন এত উত্তেজনা?
“এই ধরনের ঘটনা মহাকাশ গবেষণায় সোনার খনি খুঁজে পাওয়ার মতো,” বলছেন ইএসএ-র একজন গবেষক। তাঁর মতে, ‘আইনস্টাইন রিং’ শুধু দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য নয়, এটি মহাকর্ষীয় লেন্সিংয়ের একটি জীবন্ত উদাহরণ। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দূরবর্তী ছায়াপথগুলোর আলো প্রাকৃতিকভাবে বড় করা যায়, যা অন্যথায় ঝাপসা বা অদৃশ্য থাকত। ফলে বিজ্ঞানীরা এমন সব ছায়াপথ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, যা সাধারণ টেলিস্কোপে ধরা পড়ত না।
এই আবিষ্কারের গুরুত্ব শুধু ছায়াপথ দেখাতেই সীমাবদ্ধ নয়। গবেষকরা জানাচ্ছেন, এটি কৃষ্ণগহ্বর এবং ডার্ক ম্যাটারের মতো রহস্যময় বস্তু অধ্যয়নের ক্ষেত্রেও সহায়ক। “আমরা এখন মহাবিশ্বের সেই অংশ দেখতে পাচ্ছি, যা এতদিন আমাদের দৃষ্টির বাইরে ছিল। এটি আমাদের জন্য একটি নতুন জানালা,” বলে মন্তব্য করেছেন জেমস ওয়েব প্রকল্পের একজন বিজ্ঞানী।
মহাকর্ষীয় লেন্সিং কীভাবে কাজ করে?
মহাকর্ষীয় লেন্সিং একটি প্রাকৃতিক দূরবিনের মতো কাজ করে। যখন দুটি ছায়াপথ সরাসরি একই রেখায় থাকে এবং মাঝে একটি বৃহৎ ভরের বস্তু অবস্থান করে, তখন পেছনের ছায়াপথের আলো বিকৃত হয়ে বৃত্তাকার আকৃতি নেয়। এই ক্ষেত্রে, জেমস ওয়েব যে রিংটি ধরেছে, তা দুটি ছায়াপথের সম্মিলিত ছবি। এটি এতটাই নিখুঁত যে দেখে মনে হচ্ছে যেন মহাকাশে একটি বিশাল চোখ ভেসে আছে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই ছায়াপথগুলো পৃথিবী থেকে কয়েক বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। সাধারণভাবে এত দূরের বস্তু পরিষ্কার দেখা প্রায় আসাম্ভব। কিন্তু মহাকর্ষীয় লেন্সিংয়ের কল্যাণে আলোর তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় এই দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মহাবিশ্বকে নতুন করে চেনার পথে
এই আবিষ্কার কেন গুরুত্বপূর্ণ? বিজ্ঞানীদের মতে, এটি মহাবিশ্বের গঠন ও বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। ডার্ক ম্যাটার, যা মহাবিশ্বের প্রায় ২৭ শতাংশ ভরের জন্য দায়ী, এখনও পুরোপুরি বোধগম্য নয়। ‘আইনস্টাইন রিং’-এর মতো ঘটনা এই অদৃশ্য শক্তির প্রভাব পরিমাপে সাহায্য করতে পারে। এছাড়া, প্রাচীন ছায়াপথগুলোর গঠন অধ্যয়ন করে মহাবিশ্বের জন্ম ও বিকাশের ইতিহাসও আরও স্পষ্ট হবে।
সাধারণ মানুষের জন্য কী বার্তা?
এই ছবি শুধু বিজ্ঞানীদের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও মহাকাশের রহস্যময়তা আরও কাছে নিয়ে এসেছে। রাতে আকাশের দিকে তাকালে হয়তো আমরা ভাবি, তারার ওপারে কী আছে? ‘আইনস্টাইন রিং’ তার একটি ছোট্ট উত্তর। জেমস ওয়েবের এই আবিষ্কার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে—মহাবিশ্ব এখনও অনেক চমক লুকিয়ে রেখেছে। আগামী দিনে এই টেলিস্কোপ আরও কী দেখাবে, সেই অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্ব।