ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই বোমাবর্ষণ: মায়ানমারে জুন্টার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসংঘের ক্ষোভ

ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই বোমাবর্ষণ: মায়ানমারে জুন্টার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসংঘের ক্ষোভ

ইয়াঙ্গুন, ৩০ মার্চ ২০২৫: ৭.৭ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত মায়ানমার যখন ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছে, তখনও দেশটির সামরিক জুন্টা বিরোধীদের দমনে বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে। এই অমানবিক পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ রাষ্ট্রসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। জুন্টার এই হামলাকে ‘জঘন্য ও অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছে বিশ্ব সংস্থাটি। গত শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এই দুর্যোগে এখন পর্যন্ত ১,৭০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, আহত হয়েছেন ৩,৪০০-র বেশি, আর ৩০০ জন এখনও নিখোঁজ।

ভূমিকম্পের ধাক্কার মধ্যেই বোমার গর্জন

গত শুক্রবার দুপুর ১২:৫০-এ মায়ানমারের সাগাইং অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আঘাত হানে এই শক্তিশালী ভূমিকম্প। মান্দালে, নে পি ত এবং ইয়াঙ্গুনের মতো শহরগুলোতে ভবন ধসে পড়ে, রাস্তাঘাট ফেটে চৌচির হয়ে যায়। ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, মৃতের সংখ্যা ১০,০০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে ভূমিকম্পের তিন ঘণ্টার মধ্যে শান প্রদেশের নাংচোতে বিমান হামলা চালায় জুন্টা সেনা, যাতে ৭ জনের মৃত্যু হয়। উত্তর-পশ্চিমের সাগাইং ও থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী এলাকায়ও একইভাবে বোমাবর্ষণ চলেছে। এই অঞ্চলগুলো বর্তমানে বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে।

রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি টম অ্যান্ড্রুস ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, “যখন সবাই ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষ উদ্ধারে ব্যস্ত, তখন জুন্টা সেনা বোমা ফেলে চলেছে। এটা অকল্পনীয় এবং সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, “যারা জুন্টার ওপর প্রভাব রাখতে পারে, তাদের এখনই এই হামলা বন্ধে চাপ সৃষ্টি করা উচিত। এমন সংকটে সামরিক অভিযান বন্ধ না করা অমানবিকতার চরম নিদর্শন।”

জুন্টার বিরুদ্ধে ক্ষোভ, বিরোধীদের যুদ্ধবিরতি

মায়ানমারের সামরিক শাসক মিন অং হ্লাইং ভূমিকম্পের পরে আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য বিরল আবেদন জানিয়েছেন। ভারত, চীন, থাইল্যান্ড সহ বেশ কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে ত্রাণ পাঠিয়েছে। ভারত ‘অপারেশন ব্রহ্ম’ নামে একটি উদ্ধার ও ত্রাণ অভিযান শুরু করেছে। কিন্তু জুন্টার বোমাবর্ষণ অব্যাহত থাকায় ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধারকার্যে বড় বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। মান্দালের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি হারিয়েছি, এখন বোমার আতঙ্কে রাস্তায় রাত কাটাচ্ছি। সরকার আমাদের বাঁচাতে না এসে উলটো মারতে আসছে।”

অন্যদিকে, জুন্টা বিরোধী সংগঠন ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) এবং তাদের সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) রবিবার থেকে দুই সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। তারা জানিয়েছে, “আমরা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে এবং উদ্ধারকাজে সহায়তা করতে রাষ্ট্রসংঘ ও এনজিওদের সঙ্গে কাজ করব।” তবে জুন্টা এই যুদ্ধবিরতিতে যোগ না দিয়ে হামলা চালিয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

মানবিক সংকটের নতুন মাত্রা

২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মায়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। রাষ্ট্রসংঘের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ২ কোটিরও বেশি মানুষ এখন ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল, আর ৩৫ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত। ভূমিকম্পের পর এই সংকট আরও গভীর হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে স্থান সংকুলান হচ্ছে না, রক্তের সংকট দেখা দিয়েছে। নে পি ত-এর এক চিকিৎসক বলেন, “আমরা রোগীদের বাইরে চিকিৎসা দিচ্ছি। জায়গা নেই, ওষুধ নেই, পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।”

থাইল্যান্ডেও ভূমিকম্পের প্রভাব পড়েছে। ব্যাঙ্ককের একটি নির্মীয়মাণ ৩৩ তলা ভবন ধসে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, এখনও ১০০ জন ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে রয়েছেন। তবে মায়ানমারের তুলনায় সেখানে উদ্ধারকার্য অনেক বেশি সংগঠিত।

আগামীর চ্যালেঞ্জ

রাষ্ট্রসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট এবং বিদ্যুৎ-যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ত্রাণ পৌঁছানো কঠিন হবে। টম অ্যান্ড্রুস সতর্ক করে বলেছেন, “এই ভূমিকম্প একটি বিপর্যয়ের ওপর আরেকটি বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। আগামী কয়েক দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”

মায়ানমারের সাধারণ মানুষের জন্য এটি দ্বৈত আঘাত। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যদিকে জুন্টার নির্মমতা। আন্তর্জাতিক চাপ বাড়লেও জুন্টা তাদের অবস্থান থেকে সরবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই সংকটের মধ্যে সাধারণ নাগরিকদের দুর্ভোগই যেন শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *