মৃত্যুও শেষ নয়, ফিরে আসা সম্ভব! মার্কিন বিজ্ঞানীর দাবিতে বিশ্বজুড়ে হইচই

নিউ ইয়র্ক, ৩০ মার্চ ২০২৫: মৃত্যু মানেই কি সব শেষ? চিরকালের এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্যাম পার্নিয়ার চাঞ্চল্যকর দাবি—মৃত্যু জীবনের শেষ নয়, বরং এটি একটি প্রক্রিয়া, যাকে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে উল্টে দেওয়া সম্ভব। তাঁর এই মন্তব্য বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে তুমুল আলোড়ন তুলেছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পার্নিয়া এই বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করেছেন, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাশাপাশি মানুষের দার্শনিক চিন্তাধারাকেও নাড়া দিয়েছে।
মৃত্যু কী, শেষ নাকি শুরু?
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ল্যাঙ্গোন মেডিকেল সেন্টারের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ও রিসাসিটেশন রিসার্চের পরিচালক স্যাম পার্নিয়া দীর্ঘদিন ধরে মৃত্যু ও তার কাছাকাছি অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর সাম্প্রতিক দাবি, “মৃত্যুকে আমরা যেভাবে শেষ বলে মনে করি, তা ভুল। এটি একটি প্রক্রিয়া, যা শুরু হয় এবং কিছু সময় পর শেষ হয়। এই মাঝের সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে জীবন ফিরিয়ে আনা সম্ভব।” তিনি আরও বলেন, “হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়া বা শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে যাওয়া মানেই চূড়ান্ত মৃত্যু নয়। এটি একটি প্রতিকূল অবস্থা, যা থেকে ফেরা যায়।”
পার্নিয়ার গবেষণা মানুষের শরীরের কোষগুলোর অবিশ্বাস্য স্থিতিস্থাপকতার ওপর আলো ফেলেছে। তিনি জানান, হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার পরও মস্তিষ্ক ও শরীরের কোষগুলো তাৎক্ষণিকভাবে মরে যায় না। এই কোষগুলো কয়েক ঘণ্টা, এমনকি কয়েক দিন পর্যন্ত সচল থাকতে পারে। সঠিক সময়ে উন্নত চিকিৎসা প্রয়োগ করলে এই কোষগুলোকে পুনরায় কার্যকর করা যায়।
বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত
পার্নিয়া ও তাঁর দল কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের রোগীদের ওপর গবেষণা করে দেখেছেন, একমো (এক্সট্রা কর্পোরিয়াল মেমব্রেন অক্সিজেনেশন) যন্ত্র এবং উন্নত সিপিআর কৌশল ব্যবহার করে মৃত্যুর দুয়ার থেকে মানুষকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তিনি একটি বিশেষ “সিপিআর ককটেল” তৈরি করেছেন, যাতে রয়েছে এপিনেফ্রিন, মেটফর্মিন, ভিটামিন সি, ভ্যাসোপ্রেসিন এবং সালবুটামিনের মতো উপাদান। “এই ককটেল প্রাণীদের ওপর পরীক্ষায় সফল হয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রেও আমরা ইতিবাচক ফল দেখেছি,” বলেন পার্নিয়া।
তাঁর মতে, এই পদ্ধতি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বজায় রেখে কোষগুলোর ক্ষতি কমায় এবং মস্তিষ্ককে পুনরায় সচল করতে সাহায্য করে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা এমন রোগীদের ফিরিয়ে এনেছি, যাদের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে। এটা প্রমাণ করে মৃত্যুকে আমরা যতটা চূড়ান্ত মনে করি, ততটা নয়।”
বিজ্ঞানীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
পার্নিয়ার এই দাবি বিজ্ঞানী মহলে উত্তেজনার পাশাপাশি সংশয়ও তৈরি করেছে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জেমস বার্নস বলেন, “এই গবেষণা আশাপ্রদ, তবে এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। মানুষের মস্তিষ্কে অক্সিজেন না পৌঁছলে কয়েক মিনিটের মধ্যে স্থায়ী ক্ষতি হয়। পার্নিয়ার দাবি বাস্তবে কতটা কার্যকর, তা বড় পরিসরে পরীক্ষার পরই বোঝা যাবে।”
অন্যদিকে, লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ ড. এমিলি হার্ডিং পার্নিয়ার সমর্থনে বলেন, “একমো এবং উন্নত রিসাসিটেশন পদ্ধতি ইতিমধ্যে অনেক জীবন বাঁচিয়েছে। পার্নিয়া যে পথে এগোচ্ছেন, তা চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব আনতে পারে।”
জীবন-মৃত্যুর ধারণায় নতুন মোড়
পার্নিয়ার গবেষণা শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্যই নয়, মানব সভ্যতার দার্শনিক চিন্তার জন্যও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। শতাব্দী ধরে মৃত্যুকে জীবনের অনিবার্য সমাপ্তি হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু তিনি বলছেন, “আমাদের ধারণা বদলাতে হবে। মৃত্যু একটি রোগের মতো, যার চিকিৎসা সম্ভব।” তিনি উদাহরণ দেন, এক শতাব্দী আগে যক্ষ্মা ছিল মরণব্যাধি, কিন্তু আজ তা নিরাময়যোগ্য। মৃত্যুকেও তেমনি দেখার সময় এসেছে বলে মনে করেন তিনি।
সাধারণ মানুষের জন্য কী বার্তা?
এই গবেষণা সাধারণ মানুষের কাছে আশার আলো জাগিয়েছে। নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা মেরি জনসন, যিনি গত বছর হৃদরোগে আক্রান্ত ভাইকে হারিয়েছেন, বলেন, “যদি এই গবেষণা সত্যি হয়, তবে অনেক পরিবারের কাছে এটা নতুন আশা। আমার ভাইকে বাঁচানো যেতে পারত, এটা ভাবলেই মন ভরে যায়।”
তবে পার্নিয়া সতর্ক করে বলেছেন, “এখনও আমাদের অনেক পথ যেতে হবে। এই প্রযুক্তি এখনই সবার জন্য উপলব্ধ নয়। আরও গবেষণা ও পরীক্ষার পরই এটি বাস্তবে রূপ নেবে।” আগামী দিনে তাঁর দল এই পদ্ধতি বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করছে।
মৃত্যুকে জয় করার এই সম্ভাবনা কতটা বাস্তব, তা সময়ই বলবে। কিন্তু পার্নিয়ার এই দাবি একটি নিশ্চিত বার্তা দিচ্ছে—বিজ্ঞানের হাতে এখনও অনেক অজানা দরজা খোলার চাবি রয়েছে।