গুজরাটে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ: ২১ প্রাণহানি, ধ্বংসস্তূপে আটকে আশা

মঙ্গলবার সকালে গুজরাটের বনসকান্তা জেলার দিসায় একটি আতশবাজি কারখানায় ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণে ২১ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা সবাই মধ্যপ্রদেশের হরদা ও দেওয়াস জেলার বাসিন্দা। এই দুর্ঘটনায় তিনজন গুরুতর আহত এবং পাঁচজন সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও মানুষ আটকে থাকার আশঙ্কায় উদ্ধার অভিযান চলছে, যা মৃতের সংখ্যা বাড়ার শঙ্কা জাগিয়েছে।
সকালের নিস্তব্ধতায় মৃত্যুর ছায়া
১ এপ্রিল সকাল ৮টায় শ্রমিকরা কারখানায় আতশবাজি তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ একটি বিকট শব্দে এলাকা কেঁপে ওঠে। বয়লার বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে কারখানার ছাদ ও দেয়াল ভেঙে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, আগুনের শিখা ও কালো ধোঁয়া আকাশ ছেয়ে ফেলে। স্থানীয় কৃষক রমেশভাই প্যাটেল বলেন, “মাঠে কাজ করছিলাম। হঠাৎ কিছু পড়তে দেখে কাছে গিয়ে বুঝলাম, সেগুলো শ্রমিকদের দেহের অংশ। ৫০ মিটার দূরে ছড়িয়ে পড়েছিল।” বিস্ফোরণের শব্দ কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা গেছে।
স্বপ্নভঙ্গের করুণ কাহিনি
নিহত শ্রমিকরা দুই দিন আগে জীবিকার আশায় গুজরাটে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন রাকেশভাই নায়ক, তাঁর স্ত্রী ডালিবেন ও কন্যা কিরেনবেন। একইভাবে, লখনভাই গঙ্গারামভাইয়ের পুরো পরিবারও এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। হরদার হান্ডিয়া গ্রামে রাকেশভাইয়ের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “ও বলেছিল, এবার ভালো রোজগার নিয়ে ফিরবে। এখন তার শরীরও পুরো নেই|
আমি দুই দিন আগে আমার স্বপ্নের পিছনে এসেছি।
নিহত শ্রমিকরা সকলেই হরদা এবং দেওয়াসের দরিদ্র পরিবারের সদস্য, যারা জীবিকার সন্ধানে মাত্র দুই দিন আগে গুজরাটে পৌঁছেছিলেন। এই মানুষগুলো কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করে তাদের সন্তানদের জন্য উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখছিল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল।
উদ্ধারে দিনভর সংগ্রাম
বিস্ফোরণের পর লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দমকল বাহিনীর ৫-৬ ঘণ্টা লেগেছে। ঘটনাস্থলে কয়েক ডজন ফায়ার ইঞ্জিন পৌঁছালেও, ততক্ষণে কারখানা প্রায় ছাই হয়ে যায়। দিসার এসডিএম নেহা পাঞ্চাল জানান, “আহতদের তাৎক্ষণিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনজনের ৪০ শতাংশের বেশি দগ্ধ হয়েছে, তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।” ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার অভিযান রাত পর্যন্ত চলেছে, কারণ আরও মানুষ আটকে থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
হরদা-দেওয়াসে শোকের ছায়া
দুর্ঘটনার খবর পৌঁছাতেই মধ্যপ্রদেশের হরদা ও দেওয়াসে শোক নেমে আসে। হান্ডিয়া গ্রামের প্রধান বলেন, “এরা আমাদের গ্রামের ভরণপোষণের আশা ছিল। এখন পরিবারগুলোর কী হবে?” সন্দলপুরে ১৩ বছরের লক্ষ্মীবেনের মৃত্যুতে পরিবার ভেঙে পড়েছে। গ্রামবাসীরা সরকারের কাছে সাহায্য চাইলেও, এখন পর্যন্ত শুধু তদন্তের আশ্বাসই মিলেছে।
তদন্তে উঠছে অবহেলার অভিযোগ
দিসার এসডিএম নেহা পাঞ্চাল বলেন, “তদন্তে বয়লার বিস্ফোরণের কারণ ও নিরাপত্তা মান পালনের বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” সূত্র জানায়, কারখানাটির আতশবাজি তৈরির লাইসেন্স ছিল না, শুধু গুদাম হিসেবে অনুমতি ছিল। অথচ এখানে উৎপাদন চলছিল, যা মালিকদের গাফিলতির ইঙ্গিত দেয়। পুলিশ কারখানার পলাতক মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।
আহতদের লড়াই, উদ্ধারে আশা
হাসপাতালে গুরুতর আহত তিন শ্রমিক জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। একজন চিকিৎসক জানান, “তাদের শরীরের বড় অংশ পুড়ে গেছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।” ২১টি মৃতদেহ উদ্ধার হলেও, ত্রাণকর্মীরা মনে করছেন, ধ্বংসস্তূপে আরও জীবিত ব্যক্তি থাকতে পারেন। রাতেও উদ্ধারকাজ অব্যাহত রয়েছে।
নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
এই দুর্ঘটনা শ্রমিক নিরাপত্তা ও কারখানার অব্যবস্থাপনার গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে হরদার বাজি কারখানায় ১১ জনের মৃত্যুর ঘটনা এখনও মনে আছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কঠোর নিয়ম না মানা এবং তদারকির অভাবই এমন ঘটনার জন্য দায়ী। সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন লিখেছেন, “শ্রমিকদের জীবনের দাম কি এতই কম?”