ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৫: লোকসভায় পাশ, বিতর্কের ঝড়

দীর্ঘ ১২ ঘণ্টার তুমুল বিতর্কের পর গতকাল মধ্যরাতে লোকসভায় পাশ হয়েছে ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল ২০২৫। ২৮৮-এর বিপরীতে ২৩২ ভোটে এই বিল অনুমোদিত হয়েছে, যা ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনতে চলেছে। কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বিলটি পেশ করেন, যা এখন ‘ইউনিফাইড ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট এমপাওয়ারমেন্ট এফিশিয়েন্সি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (উমিদ) নামে পরিচিত। তবে, বিরোধী দলগুলো এটিকে ‘সংবিধানবিরোধী’ ও ‘মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকারে হস্তক্ষেপ’ বলে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই বিলের মূল পরিবর্তনগুলো কী? আসুন ১৫টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিশ্লেষণ করা যাক।
বিলের পটভূমি: প্রতিবাদ থেকে পার্লামেন্ট
গত বছর আগস্টে প্রথম পেশ করা এই বিলটি দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে যৌথ সংসদীয় কমিটিতে (জেপিসি) পাঠানো হয়। জেপিসিতে এনডিএ-র ১৪টি সংশোধনী গৃহীত হলেও বিরোধীদের ৪৪টি প্রস্তাব বাতিল হয়। ফেব্রুয়ারিতে মোদী মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর গতকাল লোকসভায় এটি পুনরায় উত্থাপিত হয়। বিতর্কে অংশ নিয়ে কংগ্রেস নেতা গৌরব গগোই বলেন, “এই বিল সংবিধানের মূল কাঠামোর ওপর আঘাত। এটি সংখ্যালঘুদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা।”
১৫টি মূল পরিবর্তন: কী বদলাচ্ছে?
১. নতুন নামকরণ: ওয়াকফ বোর্ড এখন ‘উমিদ’ নামে পরিচিত হবে, যা স্বচ্ছতা ও দক্ষতার প্রতীক বলে সরকার দাবি করছে।
২. দাতার যোগ্যতা: সম্পত্তি দানকারীকে প্রমাণ করতে হবে তিনি ৫ বছর ধরে ইসলাম পালন করছেন এবং সম্পত্তির বৈধ মালিক।
৩. মহিলাদের অধিকার: ‘ওয়াকফ-আল-আওলাদ’-এ এখন নারীরাও উত্তরাধিকারী হিসেবে সম্পত্তির আয়ের অংশ পাবেন।
৪. আদালতের ক্ষমতা: বিল কার্যকরের ৬ মাস পরেও মামলার শুনানি চলতে পারবে, যদি বিলম্বের যথাযথ কারণ দেখানো হয়।
৫. নিবন্ধন বাধ্যতামূলক: সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তির বিবরণ ৬ মাসের মধ্যে অনলাইন পোর্টালে জমা দিতে হবে।
৬. ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’: পুরনো নিয়মে দীর্ঘদিনের ব্যবহারে সম্পত্তি ওয়াকফ হতো। নতুন বিলে এটি ২০২৫-এর পর প্রযোজ্য, তবে নিবন্ধিত সম্পত্তি বৈধ থাকবে।
৭. তদন্তে পরিবর্তন: কালেক্টরের বদলে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এখন সম্পত্তি তদন্ত করবেন।
৮. অনলাইন স্বচ্ছতা: দানকারী, আয়, মুতাওয়াল্লির বেতন—সব তথ্য অনলাইনে প্রকাশিত হবে।
৯. বোর্ডের গঠন: ২ জন মুসলিম নারী ও ২ জন অমুসলিম সদস্য বাধ্যতামূলক। শিয়া, সুন্নি, ও পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত।
১০. ধারা ৪০ বিলুপ্ত: ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি ঘোষণার একক ক্ষমতা আর থাকবে না।
১১. পৃথক বোর্ড: বোহরা ও আগাখানি সম্প্রদায়ের জন্য স্বতন্ত্র ওয়াকফ বোর্ড গঠিত হবে।
১২. কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ: নিবন্ধন ও হিসাব প্রকাশে কেন্দ্র নিয়ম তৈরি করতে পারবে।
১৩. কাগজপত্র ছাড়া অবৈধ: কোনো সম্পত্তি নথি ছাড়া ওয়াকফ হিসেবে গণ্য হবে না।
১৪. মুতাওয়াল্লির যোগ্যতা: ২১ বছরের কম বয়সী, দেউলিয়া বা অপরাধী হলে মুতাওয়াল্লি পদে থাকতে পারবেন না।
১৫. সময়সীমা: বোর্ডকে ৬ মাসের মধ্যে সম্পত্তির হিসাব জমা দিতে হবে।
সরকার বনাম বিরোধী: দুই দৃষ্টিকোণ
সরকারের দাবি, এই বিল ওয়াকফ ব্যবস্থাকে আধুনিক ও স্বচ্ছ করবে। রিজিজু বলেন, “এটি ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়, বরং সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার সংস্কার।” কিন্তু বিরোধীরা এটিকে ‘মুসলিম বিরোধী’ বলে আখ্যা দিয়েছে। এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বিলটি ছিঁড়ে ফেলে বলেন, “এটি সংবিধানের সমতার নীতি লঙ্ঘন করে।”