মেলবোর্নে ভারতীয় কনস্যুলেটে ফের ভাঙচুর, খালিস্তানি যোগ খতিয়ে দেখছে পুলিশ

মেলবোর্নে ভারতীয় কনস্যুলেটে ফের ভাঙচুর, খালিস্তানি যোগ খতিয়ে দেখছে পুলিশ

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ভারতীয় কনস্যুলেটে আবারও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে, যা ভারত-অস্ট্রেলিয়া কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ১০ এপ্রিল সকাল ১টার দিকে, ৩৪৪ সেন্ট কিল্ডা রোডে অবস্থিত কনস্যুলেটের প্রধান প্রবেশপথে গ্রাফিতি আঁকা হয় এবং সম্পত্তির ক্ষতি করা হয়। ভিক্টোরিয়া পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করে অভিযুক্তদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে। এই ঘটনাকে অনেকে খালিস্তানি সমর্থকদের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করছেন, যদিও পুলিশ এখনও এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য করেনি।

ঘটনার বিবরণ

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ভাঙচুরের ঘটনাটি গভীর রাতে সংঘটিত হয়, যখন কনস্যুলেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সক্রিয় ছিল। অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীরা প্রধান প্রবেশপথে গ্রাফিতি আঁকেন, যার বিষয়বস্তু ভারত-বিরোধী স্লোগানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। “এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলা বলে মনে হচ্ছে। আমরা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করছি এবং অভিযুক্তদের শীঘ্রই গ্রেপ্তার করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি,” বলেন ভিক্টোরিয়া পুলিশের এক মুখপাত্র।

ঘটনাটি ভারতীয় কূটনৈতিক প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা অস্ট্রেলিয়ান সরকারের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন এবং কনস্যুলেটের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। “আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। কূটনৈতিক প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আয়োজক দেশের দায়িত্ব, এবং আমরা অস্ট্রেলিয়ান কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ আশা করছি,” বলেন ক্যানবেরায় ভারতীয় হাইকমিশনের এক কর্মকর্তা।

খালিস্তানি যোগ: পুনরাবৃত্তির ছায়া

অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোতে হামলার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ব্রিসবেনের তারিঙ্গায় ভারতীয় কনস্যুলেটে খালিস্তানি সমর্থকরা হামলা চালায়। পরদিনই কুইন্সল্যান্ডে ভারতের অনারারি কনস্যুলেটে খালিস্তানি পতাকা উত্তোলন করা হয়, যদিও পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে তা সরিয়ে ফেলে। এছাড়া, গত দুই বছরে মেলবোর্ন ও সিডনির শ্রী শিব বিষ্ণু মন্দির, শ্রী রাধা বল্লভ মন্দির এবং স্বামীনারায়ণ মন্দিরে ভাঙচুর ও ভারত-বিরোধী গ্রাফিতির ঘটনা ঘটেছে।

“এই ঘটনাগুলোর পেছনে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে, যা খালিস্তানি সমর্থকদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। তবে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না,” বলেন অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মাইকেল হার্ডিং। তিনি আরও যোগ করেন, “এই ধরনের হামলা কেবল কূটনৈতিক সম্পর্কের উপরই নয়, অস্ট্রেলিয়ার বহুসংস্কৃতির সমাজের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।”

আন্তর্জাতিক আইন ও দায়িত্ব

আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে, ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনস (১৯৬১) অনুসারে, কূটনৈতিক প্রাঙ্গণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আয়োজক দেশের দায়িত্ব। অস্ট্রেলিয়ার এই ধরনের পুনরাবৃত্ত ঘটনাগুলো দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। “একটি উন্নত দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার উচিত কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তায় আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। এই ঘটনাগুলো শুধু ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষতি করে না, বরং অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির উপরও প্রভাব ফেলে,” বলেন নয়াদিল্লির কূটনৈতিক বিশ্লেষক রেহানা খান।

ভারত-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কের প্রেক্ষাপট

ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়েছে। ২০২২ সালে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য চুক্তি (ইসিটিএ) স্বাক্ষরিত হয়েছে, এবং দুই দেশই কোয়াড জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তবে, এই ধরনের ঘটনা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। “এই ঘটনাগুলো যদি দ্রুত সমাধান না করা হয়, তবে এটি দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের উপর প্রভাব ফেলতে পারে,” বলেন মেলবোর্নের ভারতীয় সম্প্রদায়ের নেতা অমিত শর্মা।

স্থানীয় প্রতিক্রিয়া

মেলবোর্নের ভারতীয় সম্প্রদায় এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। “আমরা অস্ট্রেলিয়ায় শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বাস করতে চাই। এই ধরনের হামলা আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে,” বলেন স্থানীয় ভারতীয় ব্যবসায়ী রাহুল মেহতা। তিনি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আরও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার দাবি জানান।

অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও এই ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ দেখা গেছে। “এটি আমাদের বহুসংস্কৃতির মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একটি আঘাত। আমরা চাই সকল সম্প্রদায় এখানে নিরাপদে থাকুক,” বলেন মেলবোর্নের বাসিন্দা এমিলি উড।

আগামীর পথ

পুলিশ তদন্তে সিসিটিভি ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের উপর নির্ভর করছে। তবে, এই ঘটনা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে পুনরাবৃত্ত হামলার একটি অংশ। এটি কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়।

এই ঘটনা ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সহযোগিতার গুরুত্বকেও তুলে ধরেছে। দুষ্কৃতকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা রোধ করা দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তদন্তের ফলাফল এবং অস্ট্রেলিয়ান কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ এই বিষয়ে পরবর্তী দিকনির্দেশনা প্রদান করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *