বিবাহ ছাড়াই একসঙ্গে থাকার অধিকার: এলাহাবাদ হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়

বিবাহ ছাড়াই একসঙ্গে থাকার অধিকার: এলাহাবাদ হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়

এলাহাবাদ হাইকোর্ট একটি যুগান্তকারী রায়ে বলেছে, ভারতীয় সংবিধানের অধীনে প্রাপ্তবয়স্ক দম্পতিরা বিবাহ না করেও একসঙ্গে থাকার অধিকার রাখেন। ভিন্ন ধর্মের এক দম্পতির কন্যা সন্তানের পক্ষে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের শুনানিতে এই মন্তব্য করেছে বিচারপতি শেখর বি. সরফ এবং বিচারপতি বিপিন চন্দ্র দীক্ষিতের ডিভিশন বেঞ্চ। এই রায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং সামাজিক নিয়মের মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূত্রপাত করেছে।

মামলার পটভূমি

ঘটনাটি একটি এক বছর চার মাস বয়সী শিশুকন্যার পক্ষে দায়ের করা রিট পিটিশনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যার বাবা-মা ভিন্ন ধর্মের এবং ২০১৮ সাল থেকে একসঙ্গে বসবাস করছেন। মামলার আবেদনকারী দম্পতি অভিযোগ করেছেন, মেয়ের মায়ের প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে তাঁদের নিরাপত্তার হুমকি রয়েছে। এছাড়া, তাঁরা যখনই সম্ভলের চান্দৌসি থানায় এফআইআর দায়ের করতে গেছেন, পুলিশ তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে এবং অভিযোগ নথিভুক্ত করতে অস্বীকার করেছে।

মামলার বিবরণ অনুসারে, মেয়ের মা তাঁর প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর বর্তমান সঙ্গীর সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। এই সম্পর্ক থেকে তাঁদের কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। সংবিধানের ২২৬ অনুচ্ছেদের অধীনে দায়ের করা এই আবেদনে শিশুটির নিরাপত্তা এবং তার বাবা-মায়ের অধিকার রক্ষার দাবি জানানো হয়।

আদালতের রায় ও নির্দেশ

৮ এপ্রিলের রায়ে আদালত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, “সংবিধানের অধীনে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের একসঙ্গে থাকার অধিকার রয়েছে, এমনকি তাঁরা বিবাহিত না হলেও।” এই মন্তব্য ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং পছন্দের অধিকারের উপর জোর দিয়েছে। আদালত আরও বলেছে, “এই দম্পতির একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত তাঁদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে, এবং কোনো বাহ্যিক হুমকি এটিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না।”

আদালত সম্ভলের পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টকে নির্দেশ দিয়েছে, দম্পতি যদি থানায় অভিযোগ দায়ের করতে যান, তবে তাঁদের এফআইআর নথিভুক্ত করতে হবে। এছাড়া, শিশুকন্যা এবং তার বাবা-মায়ের নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা খতিয়ে দেখতে এবং আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। “আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে এই পরিবার ভয়মুক্ত পরিবেশে বসবাস করতে পারে,” বলেন বিচারপতি সরফ।

সামাজিক ও আইনি প্রেক্ষাপট

এই রায় ভারতের সামাজিক কাঠামোর প্রেক্ষিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, বিবাহ ছাড়া একসঙ্গে থাকার বিষয়টি এখনও সামাজিক নিন্দার সম্মুখীন হয়। এই প্রেক্ষাপটে, হাইকোর্টের রায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পক্ষে একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়। “এই রায় ভারতীয় সমাজে ব্যক্তিগত পছন্দের স্বীকৃতির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি স্পষ্ট করে যে সংবিধান সামাজিক রীতির উপরে রয়েছে,” বলেন আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী প্রিয়াঙ্কা শর্মা।

এই রায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের পূর্ববর্তী রায়গুলোর সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেমন ২০১৮ সালের শক্তি বাহিনী বনাম ভারত সরকার মামলা, যেখানে আদালত বলেছিল যে প্রাপ্তবয়স্কদের তাঁদের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে, এই মামলায় বিবাহের বাইরে সম্পর্কের উপর সরাসরি জোর দেওয়া এটিকে আরও উল্লেখযোগ্য করে তুলেছে।

নিরাপত্তার প্রশ্ন

দম্পতির উপর প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ির হুমকির অভিযোগ এই মামলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ভারতে, বিশেষ করে আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে, পরিবার বা সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ প্রায়ই সহিংসতার রূপ নেয়। “এই ধরনের ক্ষেত্রে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা একটি বড় সমস্যা। আদালতের নির্দেশ পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার একটি প্রচেষ্টা,” বলেন সমাজবিজ্ঞানী ড. রেহানা খাতুন।

আদালতের নির্দেশে পুলিশকে নিরাপত্তার বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে, যা এই ধরনের ক্ষেত্রে প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। এটি প্রশাসনের উপর একটি নৈতিক দায়বদ্ধতাও আরোপ করে, যাতে দম্পতি এবং তাঁদের সন্তান ভয়মুক্ত জীবনযাপন করতে পারেন।

বৃহত্তর প্রভাব

এই রায়ের প্রভাব কেবল এই দম্পতির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ভারতে লিভ-ইন সম্পর্কের আইনি স্বীকৃতি এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার পথে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। “এই রায় তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি বার্তা যে তাঁদের পছন্দের স্বাধীনতা আইন দ্বারা সুরক্ষিত। তবে, সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য এখনও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে,” বলেন আইনজ্ঞ রাকেশ সিং।

এই রায় লিভ-ইন সম্পর্কে ভারতের আইনি কাঠামোতে আরও স্পষ্টতা আনতে পারে, বিশেষ করে সম্পত্তি, উত্তরাধিকার এবং সন্তানের অধিকারের ক্ষেত্রে। এটি সরকারের জন্যও একটি সংকেত যে এই ধরনের সম্পর্কের জন্য সুনির্দিষ্ট আইনি নির্দেশিকা প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *