চীনের খনিজ নিষেধাজ্ঞায় কাঁপছে মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্প, বাণিজ্য যুদ্ধে নতুন মোড়

আমেরিকা ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে চীনের বিরল খনিজ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আমেরিকার ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের জবাবে চীন আমেরিকান পণ্যে ১২৫ শতাংশ শুল্ক ধার্য করার পাশাপাশি হলিউড চলচ্চিত্রের মুক্তি সীমিত করা এবং বিরল খনিজ সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা মার্কিন যুদ্ধবিমান, পরবর্তী প্রজন্মের এয়ার ডমিন্যান্স প্রোগ্রাম (এনজিএডি), এমনকি বোয়িংয়ের উৎপাদনের মেরুদণ্ডকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলেছে।
চীনের নিষেধাজ্ঞা: কোন খনিজ, কেন গুরুত্বপূর্ণ?
চীন সাতটি বিরল খনিজ—ডিসপ্রোসিয়াম, সামারিয়াম, গ্যাডোলিনিয়াম, টারবিয়াম, লুটেটিয়াম, স্ক্যান্ডিয়াম এবং ইট্রিয়াম—রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। এই খনিজগুলো প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, ডিসপ্রোসিয়াম উচ্চ তাপমাত্রার চুম্বকে ব্যবহৃত হয়, যা জেট ইঞ্জিনের কার্যকারিতা বজায় রাখে। “এই চুম্বকগুলো ছাড়া আধুনিক যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন অকেজো হয়ে পড়তে পারে,” বলেন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি বিশ্লেষক অরুণ সিং।
ইট্রিয়াম উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি রাডার, নির্ভুল লেজার এবং জেট ইঞ্জিনের তাপীয় আবরণে অত্যাবশ্যক। এটি বিমানের ইঞ্জিনকে উচ্চ তাপমাত্রায় গলে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। এছাড়া, টাইটানিয়াম, টাংস্টেন এবং নিওবিয়ামের মতো ধাতু স্টিলথ প্রযুক্তি এবং কাঠামোগত শক্তি নিশ্চিত করে। “এই খনিজগুলো ছাড়া এফ-৪৭, এফ-২২ বা এনজিএডি প্রোগ্রামের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত,” বলেন ওয়াশিংটন-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ জেমস হার্ডি।
প্রতিরক্ষার বাইরেও প্রভাব
বিরল খনিজের গুরুত্ব শুধু প্রতিরক্ষা শিল্পেই সীমাবদ্ধ নয়। এগুলো সেমিকন্ডাক্টর, মাইক্রোচিপ, বৈদ্যুতিক গাড়ি, এআই প্রযুক্তি এবং মহাকাশ গবেষণায় অপরিহার্য। গ্যালিয়াম, যা চীন আগেই নিষিদ্ধ করেছে, ইলেকট্রনিক্স এবং সৌর প্যানেলে ব্যবহৃত হয়। “এই নিষেধাজ্ঞা মার্কিন প্রযুক্তি খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংকট সৃষ্টি করতে পারে। কম্পিউটার চিপ থেকে শুরু করে স্যাটেলাইট—সবই ঝুঁকির মুখে,” বলেন প্রযুক্তি বিশ্লেষক রেহানা খাতুন।
মার্কিন অর্থনীতির প্রায় ৭০ শতাংশ বিরল খনিজ চীন থেকে আমদানি করা হয়। চীন ছাড়াও রাশিয়া এবং ইরানের মতো দেশগুলো এই খনিজ সম্পদের মজুদ নিয়ন্ত্রণ করে। “এই খনিজগুলো চীনের তূণে তীরের মতো, যা তারা সঠিক সময়ে ব্যবহার করছে,” বলেন কলোরাডো স্কুল অফ মাইন্সের অধ্যাপক টম ব্র্যাডি।
বাণিজ্য যুদ্ধের নতুন অধ্যায়
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যে শুল্ক ১৪৫ শতাংশে উন্নীত করার পর চীন দ্রুত পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে। আমেরিকান পণ্যে ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের পাশাপাশি বেইজিং হলিউড চলচ্চিত্রের মুক্তি সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা মার্কিন বিনোদন শিল্পের জন্য বড় ধাক্কা। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো বিরল খনিজের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা।
“চীন এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে মার্কিন অর্থনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত করছে। এটি কেবল প্রতিরক্ষা নয়, প্রযুক্তি এবং শিল্প উৎপাদনের ভিত্তিও ক্ষতিগ্রস্ত করবে,” বলেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক প্রিয়াঙ্কা শর্মা। চীন বিশ্বের ৭০ শতাংশ বিরল খনিজ উৎপাদন এবং ৯০ শতাংশ প্রক্রিয়াকরণ নিয়ন্ত্রণ করে, যা তাদের এই যুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান দেয়।
মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পে আতঙ্ক
মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। এফ-৪৭ এবং এফ-২২ এর মতো যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে এনজিএডি প্রোগ্রাম—সবই এই খনিজের উপর নির্ভরশীল। বোয়িংয়ের উৎপাদনেও এর প্রভাব পড়তে পারে। “এই খনিজ ছাড়া আমাদের বিমান বাহিনীর পরবর্তী প্রজন্মের প্রযুক্তি বাস্তবায়ন প্রায় আসাম্ভব। বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে বছরের পর বছর লাগবে,” বলেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ হার্ডি।
মার্কিন সরকারের কাছে কিছু বিরল খনিজের মজুদ রয়েছে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা মেটাতে অপর্যাপ্ত। চীনের এই পদক্ষেপের ফলে মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদাররা সরবরাহ শৃঙ্খলে সংকটের মুখে পড়তে পারেন।
মার্কিন প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ
ট্রাম্প প্রশাসন চীনের উপর থেকে নির্ভরতা কমাতে দেশীয় খনিজ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। তিনি ইতিমধ্যে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন, যা খনিজ উৎপাদন ত্বরান্বিত করা এবং অনুমতি প্রক্রিয়া সহজ করার কথা বলে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, নতুন খনি ও প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র চালু করতে কয়েক বছর সময় লাগবে। “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিরল খনিজ প্রক্রিয়াকরণের অবকাঠামো সীমিত। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সময় এবং বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন,” বলেন খনিজ বিশেষজ্ঞ রাকেশ গুপ্তা।
এদিকে, চীনের হলিউড চলচ্চিত্রের উপর বিধিনিষেধ মার্কিন সাংস্কৃতিক রপ্তানির উপর চাপ সৃষ্টি করছে। “এটি একটি বহুমুখী যুদ্ধ। চীন অর্থনীতি, প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রেই মার্কিন প্রভাব কমাতে চাইছে,” বলেন শর্মা।
বিশ্বব্যাপী প্রভাব
এই বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব শুধু আমেরিকা ও চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপের মতো দেশগুলোও চীনের খনিজ সরবরাহের উপর নির্ভরশীল। চীনের এই পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলকে বিঘ্নিত করতে পারে, যা ইলেকট্রনিক্স, বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে মূল্যবৃদ্ধির কারণ হতে পারে। “এটি একটি ডমিনো প্রভাব সৃষ্টি করবে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিটি কোণে এর প্রভাব পড়বে,” বলেন অর্থনীতিবিদ সৌম্যজিৎ দাস।