বানু মুশতাক: ‘হার্ট ল্যাম্প’-এর কান্নাড়া লেখিকা, যিনি জিতলেন আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার

বানু মুশতাক কে?
কর্নাটকের হাসানে ১৯৪৮ সালে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী বানু মুশতাক একজন প্রখ্যাত লেখিকা, সমাজকর্মী এবং আইনজীবী। তিনি ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে বান্দায়া সাহিত্য আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসেন, যা জাতি ও শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সাহিত্য রচনায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। তিনি কান্নাড়া ভাষায় লেখেন এবং তাঁর রচনা উর্দু, হিন্দি, তামিল, মালয়ালম এবং সম্প্রতি ইংরেজিতেও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লঘুকথা সংকলন হার্ট ল্যাম্প, দীপা ভাস্থির ইংরেজি অনুবাদে, ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতেছে, যা প্রথম কান্নাড়া গ্রন্থ হিসেবে এই সম্মান অর্জন করেছে।
শিক্ষাগত পটভূমি
বানু মুশতাক হাসানের এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা উর্দু মাধ্যমে শুরু হলেও, আট বছর বয়সে তিনি শিবমোগার একটি কান্নাড়া-মাধ্যম মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ছয় মাসের মধ্যে কান্নাড়া পড়তে ও লিখতে শেখার শর্ত দিয়েছিল, কিন্তু তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই লিখতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং হাসানের এম কৃষ্ণা ল কলেজ থেকে আইনের ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর স্বামী মুশতাক মহিউদ্দিন তাঁকে আইন পড়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন।
সাহিত্য ও সমাজকর্ম
বানু মুশতাক ছয়টি লঘুকথা সংকলন, একটি উপন্যাস (কুবরা), একটি নিবন্ধ সংকলন (ইব্বানিয়া কাভু) এবং একটি কবিতা সংকলন (ওদ্দে কন্নিনা বাগিনা) রচনা করেছেন। তাঁর প্রথম গল্প ‘নানু অপরাধিয়ে’ ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি লঙ্কেশ পত্রিকের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কর্মরত ছিলেন। তাঁর লেখায় দক্ষিণ ভারতের মুসলিম নারীদের দৈনন্দিন জীবন, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সামাজিক বৈষম্যের প্রতিবাদ প্রকট। তিনি কর্নাটক সাহিত্য অকাদেমি এবং দানা চিন্তামণি অট্টিমাব্বে পুরস্কার জিতেছেন।
হার্ট ল্যাম্প
হার্ট ল্যাম্প ১২টি লঘুকথার সংকলন, যা ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে লেখা। এটি দক্ষিণ ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের নারীদের জীবন, তাঁদের সংগ্রাম, স্থিতিস্থাপকতা এবং বুদ্ধিদীপ্ত বোনহুডের গল্প তুলে ধরে। বুকার পুরস্কার প্যানেল এটিকে “মজার, প্রাণবন্ত, কথোপকথনমূলক এবং তীক্ষ্ণ” হিসেবে প্রশংসা করেছে। মুশতাক বলেন, “প্রতিটি গল্প মানবিক অভিজ্ঞতার সুতো, যা সমাজের তানে-বুনে অপরিহার্য।”
সামাজিক সংগ্রাম
বানু মুশতাক নারী অধিকার, বিশেষ করে মুসলিম নারীদের মসজিদে প্রবেশ এবং হিজাব পরার অধিকারের পক্ষে সোচ্চার। ২০০০ সালে তাঁর এই অবস্থানের জন্য সম্প্রদায়ের তরফে সামাজিক বয়কট এবং হত্যাচেষ্টার মুখোমুখি হন। তিনি বাবা বুদানগিরি তীর্থস্থানে মুসলিমদের প্রবেশে বাধা দেওয়ার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
২৬ বছর বয়সে প্রেমের বিয়ে করেন মুশতাক মহিউদ্দিনের সঙ্গে, যা তাঁর সম্প্রদায়ের প্রথার বিরুদ্ধে ছিল। তিনি পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন, যা তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয়। তাঁর স্বামী তাঁকে সাহিত্য ও আইনের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছেন।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
হার্ট ল্যাম্প ২০২৫ সালে ৫০,০০০ পাউন্ডের আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতেছে। এটি প্রথম কান্নাড়া গ্রন্থ এবং প্রথম লঘুকথা সংকলন হিসেবে এই পুরস্কার অর্জন করেছে। মুশতাকের অন্যান্য কাজের মধ্যে হাসিনা মাত্তু ইতারা কাথেগালু (২০১৩) এবং হেন্নু হাদ্দিনা স্বয়ংবরা (২০২৩) উল্লেখযোগ্য। তাঁর গল্প হাসিনা গিরিশ কাসারভল্লির পরিচালনায় চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে।
মুশতাকের বক্তব্য
“এই পুরস্কার হাজার জোনাকির আলোয় একটি আকাশ জ্বালানোর মতো—সংক্ষিপ্ত, উজ্জ্বল এবং সম্পূর্ণ সমষ্টিগত। আমার লেখা সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমার লড়াইয়ের অংশ।” তিনি নারী ও প্রান্তিক সম্প্রদায়ের সংগ্রামের গল্প তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।