তুরস্কের পাকিস্তান সমর্থন ভারতের ক্ষোভের কারণ, বয়কটে অর্থনৈতিক ধাক্কা-সম্পর্কে ফাটল

ভারত-তুরস্ক সম্পর্কে উত্তেজনা: জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগামে ২২ এপ্রিল, ২০২৫-এ সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা তীব্র হয়। ভারত ৭ মে ‘অপারেশন সিন্দুর’ পরিচালনা করে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করে। এই সংঘাতে তুরস্ক পাকিস্তানকে সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, যা ভারত-তুরস্ক সম্পর্কে গভীর ফাটল সৃষ্টি করেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল ২২ মে, ২০২৫-এ বলেন, “আমরা তুরস্কের কাছে আশা করি, তারা পাকিস্তানকে সীমান্ত-সন্ত্রাসবাদে সমর্থন বন্ধ করবে এবং দশকের পর দশক ধরে পোষিত সন্ত্রাসী ইকোসিস্টেমের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য ও যাচাইযোগ্য পদক্ষেপ নেবে।”
তুরস্কের সামরিক সমর্থন: অপারেশন সিন্দুরের পর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে ৩০০-৪০০টি ড্রোন ব্যবহার করে হামলার চেষ্টা করে, যার বেশিরভাগই তুরস্কে তৈরি বায়রাক্তার টিবি২, আসিসগার্ড সোঙ্গার এবং ইয়িহা ড্রোন ছিল। এই ড্রোনগুলো লাদাখের লেহ থেকে গুজরাটের সর ক্রিক পর্যন্ত ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে। তুরস্ক শুধু ড্রোনই সরবরাহ করেনি, দুজন তুর্কি সামরিক উপদেষ্টাও পাকিস্তানকে পাঠিয়েছিল, যাদের অপারেশন সিন্দুরে নিহত করা হয়। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, “তুরস্ক সব সময় পাকিস্তানের পাশে থাকবে।” এই অবস্থান ভারতের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
ভারতের কঠোর হুঁশিয়ারি: ভারত তুরস্ককে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, পাকিস্তানের সমর্থন অব্যাহত রাখলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তুরস্কের কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলা এবং জাতিসংঘে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ভারত-তুরস্ক সম্পর্কে দীর্ঘদিনের উত্তেজনার কারণ। ভারত বারবার তুরস্ককে তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে এবং সন্ত্রাসবাদের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে বলেছে।
BoycottTurkey আন্দোলন ও অর্থনৈতিক প্রভাব: তুরস্কের পাকিস্তান সমর্থনের প্রতিবাদে ভারতে #BoycottTurkey ট্রেন্ড সোশ্যাল মিডিয়ায় শীর্ষে রয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তুরস্কের আপেল, মার্বেল, কফি, চকলেট ইত্যাদি পণ্য বয়কট করছে। কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স (সিএআইটি) তুরস্ক ও আজারবাইজানের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। ইজিমাইট্রিপ, মেকমাইট্রিপ এবং কক্স অ্যান্ড কিংসের মতো ট্রাভেল এজেন্সি তুরস্কে ভ্রমণ বুকিং বন্ধ করেছে, যার ফলে বুকিং ৬০% কমে গেছে এবং বাতিলকরণ ২৫০% বেড়েছে। ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তুরস্কে শুটিং বন্ধ করেছে, এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তুর্কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে। তুরস্কের অর্থনীতি, যা ইতিমধ্যে ৪০% মুদ্রাস্ফীতি এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের সমস্যায় ভুগছে, এই বয়কটে ৩২,০০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত থেকে তুরস্কে রপ্তানি ৫.২ বিলিয়ন ডলার এবং আমদানি ২.৮৪ বিলিয়ন ডলার ছিল, কিন্তু বয়কটের কারণে তুরস্কের রপ্তানি ১৭% কমেছে।
তুরস্কের অর্থনৈতিক দুর্বলতা: তুরস্কের অর্থনীতি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ঋণ, এবং তুর্কি লিরার অবমূল্যায়নের কারণে দুর্বল। ভারত তুরস্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার না হলেও, ভারতীয় পর্যটন তুরস্কের অর্থনীতিতে বছরে ৪,০০০ কোটি টাকার অবদান রাখে। তুরস্কের নিট রিজার্ভ শূন্যের কাছাকাছি, এবং তরল রিজার্ভ মাত্র ২০-৪০ বিলিয়ন ডলার। ভারতের ২.৩ বিলিয়ন ডলারের জাহাজ নির্মাণ চুক্তি বাতিল এবং তুর্কি কো ম্পা নি সেলেবি এভিয়েশনের নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিল তুরস্কের প্রতিরক্ষা ও পরিষেবা খাতে বড় ধাক্কা।
ভারতের অবস্থান ও অপারেশন দোস্তের প্রসঙ্গ: ভারতীয়রা তুরস্কের এই অবস্থানকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখছে, বিশেষ করে ২০২৩ সালে তুরস্কের ভূমিকম্পের সময় ভারতের ‘অপারেশন দোস্ত’-এর মাধ্যমে প্রদত্ত সাহায্যের পর। ভারত ত্রাণ সামগ্রী, চিকিৎসা সরঞ্জাম, এবং এনডিআরএফ দল পাঠিয়েছিল, কিন্তু তুরস্ক এখন পাকিস্তানের মাধ্যমে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক সমর্থন দিচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় #BoycottTurkey ট্রেন্ডে হর্ষ গোয়েঙ্কা, প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী, এবং রূপালি গঙ্গুলির মতো ব্যক্তিত্বরা তুরস্কের পর্যটন ও পণ্য বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন।
উপসংহার: তুরস্কের পাকিস্তান সমর্থন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, এবং ভারতের জনগণ ও সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। তুরস্ককে এখন পাকিস্তানের পক্ষে থাকা এবং অর্থনৈতিক ধ্বংসের মধ্যে একটি বেছে নিতে হবে। ভারতের বয়কট তুরস্কের পর্যটন, বাণিজ্য, এবং প্রতিরক্ষা খাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করতে পারে, এবং এই কূটনৈতিক সংকট দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তুরস্কের ভবিষ্যৎ এখন ভারতের পদক্ষেপের উপর নির্ভর করছে।