পেটজুড়ে অসংখ্য সিস্ট- চার ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে তরুণীর প্রাণ বাঁচাল বর্ধমান মেডিক্যাল

এক অত্যন্ত জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এক তরুণীর জীবন বাঁচিয়ে নজির স্থাপন করেছে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ওই তরুণীর পেটে অসংখ্য ‘হাইডাটিড সিস্ট’ বাসা বেঁধেছিল, যা সফলভাবে অপসারণ করে হাসপাতালটি তাদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, এই ধরনের অস্ত্রোপচার বর্ধমান মেডিক্যালে এই প্রথমবার ঘটল, এবং গোটা রাজ্যের মধ্যে এটি দ্বিতীয় ঘটনা।
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসেই বর্ধমানের ১৮ বছর বয়সী এক তরুণী চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন। তাঁর সারা শরীর ক্রমশ রোগা হয়ে যাচ্ছিল, অথচ পেট অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠছিল। পাশাপাশি, ঠিকভাবে খেতে না পারা সহ আরও কিছু উপসর্গ ছিল। আউটডোরে চিকিৎসকদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। ইউএসজি (USG) এবং সিটি স্ক্যান (CT Scan) এর রিপোর্টে চিকিৎসকরা জানতে পারেন যে, তরুণীর পেটে অসংখ্য ‘হাইডাটিড সিস্ট’ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন আকারের এই সিস্টগুলি তাঁর পুরো পেটজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, যা অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে চিকিৎসকদের।
চিকিৎসকরা ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘হাইডাটিড সিস্ট’ হলো ছোট বেলুনের মতো দেখতে এক ধরনের বস্তু, যার ভিতরে তরল পদার্থ থাকে। বেলুনের মতো এই অংশটি তরল পদার্থ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুলে ওঠে। সাধারণত গৃহপালিত পশুদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়। এই রোগের জীবাণুর ডিম বা লার্ভা মানুষের শরীরে সাধারণত কাঁচা শাকসবজির মাধ্যমে প্রবেশ করে।
গত ১৪ই মে, এক দীর্ঘ চার ঘণ্টার জটিল অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন করেন চিকিৎসকরা। এই অপারেশনে শল্য চিকিৎসকদের পাশাপাশি অ্যানেসথেসিস্টদেরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শল্য চিকিৎসক নাজমস সাজাদ জামাদার এবং কুশল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের তিন অভিজ্ঞ চিকিৎসক সুমন্ত ঘোষমৌলি, বিকাশ বিষয়ী এবং সৌমেন মণ্ডল। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর সিস্টগুলি সফলভাবে বের করে আনা হয়। হাসপাতাল সুপার তাপস ঘোষ এই প্রসঙ্গে বলেন, “এই হাইডাটিড সিস্ট মানুষের গোটা পেটের ভিতরে এমনভাবে ছড়িয়ে গিয়েছিল যা গুনে শেষ করা যেত না। এমন রোগী বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এর আগে কখনও আসেনি। রাজ্যেও এটি দ্বিতীয় ঘটনা। এত দীর্ঘ ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই অস্ত্রোপচার। সামান্য একটু ভুলেই রোগী অপারেশন টেবিলেই মারা যেতে পারতেন। আমাদের দক্ষ টিম অত্যন্ত সফলভাবে এই কাজটা করেছেন। ওই তরুণী এখন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং বিপদমুক্ত।” জানা গেছে, আগামী দু-তিন দিনের মধ্যেই তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
শল্য চিকিৎসক নাজমস সাজাদ জামাদার আরও জানিয়েছেন, হাইডাটিড সিস্ট একটি সাধারণ অসুখ হলেও, এটি সাধারণত লিভার বা ফুসফুসের মতো অঙ্গে বেশি দেখা যায়। তবে শরীরের অন্য কোনো অংশে এটি ছড়িয়ে পড়লে তাকে বিরল হিসেবে দেখা হয়। এই রোগীর ক্ষেত্রে সিস্টটি পেটের গোটা অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল, যা সাধারণত দেখা যায় না। চার ঘণ্টার অপারেশনের সময় অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের চিকিৎসকদের সহযোগিতা ছাড়া এই সাফল্য সম্ভব ছিল না। আরেক শল্য চিকিৎসক কুশল চট্টোপাধ্যায় সতর্ক করে বলেন, “কাঁচা সবজি যেমন বিট, গাজর, শশা, পিঁয়াজ, লেটুস পাতা ইত্যাদি খাবার থেকেই হাইডাটিড সিস্টের জীবাণু সাধারণত মানব শরীরে প্রবেশ করে। কাঁচা সবজি খাবার আগে খুব ভালো করে অবশ্যই ধুয়ে নেওয়া প্রয়োজন। না ধুয়ে বা অল্প ধুয়ে বা মুছে নিয়ে, হাত দিয়ে পরিষ্কার করে কোনো কাঁচা সবজি খাবেন না।” তিনি আরও যোগ করেন যে, সাধারণত কুকুর, ছাগল বা ভেড়া থেকে এই রোগের জীবাণু ছড়ায়। সুপার তাপস ঘোষের মতে, “হাইডাটিড সিস্ট রোগটি আমরা একটু সচেতন থাকলেই এড়াতে পারি।”