৩০ বছরে জাভা! এক যুগান্তকারী স্বপ্ন কতটা বাস্তব হলো

৩০ বছরে জাভা! এক যুগান্তকারী স্বপ্ন কতটা বাস্তব হলো

আজ থেকে ঠিক ৩০ বছর আগে, ১৯৯৫ সালের মে মাসে, প্রোগ্রামিং ভাষা জাভা প্রথমবার সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। এর মাধ্যমে বিশ্ব প্রথম পরিচিত হয় “রাইট ওয়ান, রান অ্যানিহোয়্যার” (WORA) অর্থাৎ একবার কোড লিখলেই সব জায়গায় চলবে-এমন যুগান্তকারী ধারণার সঙ্গে। ডেভেলপারদের জন্য এটি সিসি++ এর চেয়ে সহজ এবং ব্যবহারবান্ধব একটি ভাষা হিসেবে দ্রুত পরিচিতি লাভ করে।

ওক থেকে জাভা ওয়েবের হাত ধরে উত্থান

প্রাথমিকভাবে জাভার নাম ছিল ‘ওক’। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে সান মাইক্রোসিস্টেমস-এ জেমস গসলিং এটি তৈরি করেছিলেন। শুরুতে ডিজিটাল ডিভাইসের জন্য বানানো হলেও, পরে এর লক্ষ্য পরিবর্তিত হয় ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের দিকে। জাভা ভাষা অনেকটা সি ও সি++ এর মতো হলেও এটি সাধারণত বাইটকোডে কম্পাইল হয়, যা তত্ত্ব অনুযায়ী যেকোনো ‘জাভা ভার্চুয়াল মেশিন’ (JVM)-এ চলতে পারে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল WORA বাস্তবায়ন করা। তবে বাস্তবে বিভিন্ন জেভিএম-এর সূক্ষ্ম পার্থক্যের কারণে এই স্বপ্ন সবসময় পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। প্রযুক্তি বিষয়ক সাইট রেজিস্টার-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিত জেভিএম সমস্যা দেখা দিত, যা অ্যাপের আচরণকে অনুমান করা কঠিন করে তুলত।

প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও জনপ্রিয়তার উত্থান-পতন

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জাভা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং দ্রুতই অনেক সফটওয়্যার কো ম্পা নির জন্য এটি মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে। এর প্রতিক্রিয়ায় মাইক্রোসফট তাদের নিজস্ব সংস্করণ ‘ভিজুয়াল জে++’ চালু করে। যদিও এটি জাভার ভাষাগত নিয়ম মেনে চলত, সান মাইক্রোসিস্টেমস-এর নির্ধারিত পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। এ কারণে ১৯৯৯ সালে সান মাইক্রোসিস্টেমস মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে মামলা করে। এরপর ২০০০ সালে মাইক্রোসফট ‘ভিজুয়াল স্টুডিও’ থেকে জে++ সরিয়ে ফেলে এবং ধীরে ধীরে এটিকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়।

জাভা প্রকাশের পর থেকেই এর জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে, কারণ ডেভেলপাররা বিকল্প ভাষার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছেন। এরপরও ২০২৪ সালের ‘স্ট্যাক ওভারফ্লো সার্ভে’-তে জাভা ছিল শীর্ষ ১০ ভাষার মধ্যে একটি এবং সি#, সি++ ও সি-এর চেয়ে এগিয়ে। টিআইওবিই সূচকেও জাভার জনপ্রিয়তা কমেছে; একসময় এটি শীর্ষে থাকলেও, এখন চার নম্বরে অবস্থানে রয়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ভাষা হিসেবে রয়েছে পাইথন। তবে ২০১৫ সালে টিআইওবিই জাভাকে ‘বছরের সেরা ভাষা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল।

জাভার স্থায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ

সোনাটাইপ-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিটিও ব্রায়ান ফক্স বলেছেন, “জাভা নানা ট্রেন্ড, প্রতিদ্বন্দ্বী ভাষা আর পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি ধারার মধ্যেও টিকে আছে। অ্যাপলেট আর সার্ভলেট থেকে শুরু করে আজকের মাইক্রোসার্ভিস ও ক্লাউডনেটিভ আর্কিটেকচার পর্যন্ত জাভা নিজেকে বদলেছে, কিন্তু পরিচিতভাবেই থেকেছে। এটি এমন একটি পথ তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে ওপেন সোর্স প্রযুক্তি প্রথমবারের মতো বড় প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের পথ তৈরি করতে পেরেছে।” তিনি আরও বলেন, “বলা যায়, একবার জাভাকে গ্রহণ করার পর কোনো কো ম্পা নি আর পেছনে ফিরে তাকায়নি।”

বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণে জাভা কোড ব্যবহৃত হচ্ছে, তা প্রমাণ করে যে প্রোগ্রামিংয়ের ট্রেন্ড আসা-যাওয়া করলেও জাভার চাহিদা এখনও রয়ে গিয়েছে। জাভার ব্যাপক ব্যবহার, দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং অনেক ব্যাক-অফিস সিস্টেমে এর উপস্থিতি দেখে কিছু ইঞ্জিনিয়ার হয়তো কোবোল-এর কথা ভাবতে পারেন। তবে ৩০ বছর আগে সেই বাস্তবতায় জাভা ছিল তার সমসাময়িক বিভিন্ন ভাষার মধ্যে একদম আধুনিক ও নতুন একটি হাওয়ার মতো। পোর্টেবল হওয়ার কারণে ওইসময় অনেকেই এর প্রতি ঝুঁকেছিলেন।

ওরাকলের মালিকানা এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

এই ৩০ বছরের যাত্রা সবসময় সহজ ছিল না। ২০১০ সালে সান মাইক্রোসিস্টেমস-কে কিনে নেয় ওরাকল। সান মাইক্রোসিস্টেমস-এর বেশিরভাগ জেভিএম ওপেন সোর্স করা হলেও, এটি কেনার পর ওরাকল ফ্রি না রেখে লাইসেন্স ফি নেওয়া শুরু করে। ২০২৩ সালে তারা নিজেদের সাবস্ক্রিপশন মডেলের লাইসেন্স শর্ত পরিবর্তনও করে, যা বিভিন্ন ব্যবসার জন্য হাজার হাজার ডলার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ বছরের শুরুতে এক গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতি দশ জন জাভা ব্যবহারকারীর মধ্যে কেবল একজনই ওরাকলের সঙ্গে লেগে থাকতে চান।

তবে জাভা ব্যবহারের পরিসর এতটাই বড় যে, জাভার বিকল্প সংস্করণও সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে ওরাকল। আর এ কারণে ওরাকলের কথিত ‘আগ্রাসী লাইসেন্সিং নীতি’র পরও জাভার জনপ্রিয়তায় তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। এটি এখনও অনেক ডেভেলপারের কাছে প্রিয় এবং কো ম্পা নির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৩০ বছরের পথচলায় জাভা নতুন ও উদীয়মান ভাষা থেকে হয়ে উঠেছে এমন একটি টুল, যার ওপর নির্ভরশীল এই সময়ের অনেক কো ম্পা নি। হয়তো বর্তমানের এআইনির্ভর বিভিন্ন অ্যাপের মতো ঝকঝকে নতুন ফিচার জাভার নেই, তবে এখনও আধুনিক সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের মজবুত ভিত্তি হিসেবেই রয়ে গিয়েছে এটি। জাভার সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম ও বিস্তৃত ডেভেলপার কমিউনিটি থেকে ইঙ্গিত মেলে, জাভা এখনও কেবল প্রাসঙ্গিকই নয়, বরং চতুর্থ দশকে পা রাখার পরও এটি শক্তভাবেই এগিয়ে চলেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *