মাত্র আধ ঘণ্টায় ভারত থেকে আমেরিকা! যদি পৃথিবীর এপার-ওপার খোঁড়া যায়, কী ঘটবে?

পৃথিবীর গভীরে সুড়ঙ্গ খননের ধারণা মানবজাতির কাছে বরাবরই কৌতূহলোদ্দীপক। কল্পনা করুন, যদি ভারত থেকে আমেরিকায় মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছানো যেত, তাহলে পৃথিবীটা কতটা ছোট হয়ে যেত! বিমান ভ্রমণের চেয়েও দ্রুত এই যাত্রা মাধ্যাকর্ষণের সাহায্যে সম্ভব হতে পারত। কিন্তু সত্যিই কি এমনটা করা সম্ভব? যদি পৃথিবীর এপার থেকে ওপার একটি সুড়ঙ্গ খোঁড়া যায়, তাহলে কী ঘটবে এবং এর প্রভাব কী হবে?
কেন গভীর খনন এত কঠিন?
যদি পৃথিবীর এপার-ওপার একটি সুড়ঙ্গ খোঁড়া যায়, তাহলে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া খুবই সহজ হয়ে যাবে। যেমন, আপনি ভারত থেকে আমেরিকায় মাত্র কয়েক মিনিটেই পৌঁছে যাবেন। কিন্তু এটা কি সম্ভব? সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমাদের কাছে বর্তমানে এমনটা করার প্রকৌশলগত ক্ষমতা নেই। যদিও, একবার এমন একটি প্রচেষ্টা হয়েছিল, যা প্রায় ১৯ বছর ধরে চলেছিল। এই সময়ে, বেশ কিছু গবেষক সুড়ঙ্গ খনন করে এটা পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছেন যে তারা পৃথিবীর কতটা গভীরে যেতে পারেন। তাহলে, চলুন জেনে নিই এটা সম্ভব কিনা।
আপনি কি বিশ্বের অন্য প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য খনন করতে পারবেন? যখন আমরা বিশ্বের অন্য প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য একটি সুড়ঙ্গ খনন করি, তখন আমাদের পৃথিবীর ব্যাস (Diameter) অতিক্রম করতে হয়, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১২,৭৪২ কিলোমিটার। যেখানে কোলা ওয়েলে রুশদের দ্বারা খোঁড়া সুড়ঙ্গের গভীরতা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৭ কিলোমিটার (২৩,০০০ ফুট)। এই প্রকল্পটি ১৯৭০ সালে শুরু হয়েছিল এবং পাঁচ বছরের মধ্যেই এই গভীরতা অর্জন করা হয়েছিল। তারপর ১৯৮৯ সালে এটি বাতিল করা হয়, কারণ খননের সময় পৃথিবীর পৃষ্ঠের প্রায় ১২ কিলোমিটার গভীরে কঠিন পাথুরে স্তরে ড্রিলিং আটকে যায়।
এত গভীরে খনন করা কেন কঠিন? গভীরে তাপমাত্রা খুব বেশি থাকে (৫০০°C এরও বেশি), শিলাগুলি অত্যন্ত কঠিন ও জটিল হয়। চাপ এত বেশি থাকে যে মেশিনগুলি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এই সমস্ত কারণে, আজকের প্রযুক্তি দিয়েও পৃথিবীকে অতিক্রমকারী সুড়ঙ্গ তৈরি করা আসাম্ভব। এই কারণেই সুড়ঙ্গ খননে প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জগুলি অনেক বড়। এমনকি উভয় দিক থেকে খনন করা হলেও, এটি সম্ভব হবে না, কারণ উভয় প্রচেষ্টায় ৬,০০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু তবুও মানুষের মনে এই প্রশ্ন থাকবে যে, যদি বিশ্বজুড়ে কোথাও সুড়ঙ্গ খনন সফল হয় তাহলে কী হবে?
যদি আমরা সারা বিশ্বে সুড়ঙ্গ খনন করতে সফল হই তবে কী হবে?
আমরা সবসময় কল্পনা করে এসেছি যে এত দূর পর্যন্ত সুড়ঙ্গ খনন করলে আমরা বিশ্বের অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে পারব। এর অর্থ হলো, যদি আমরা দূরত্বকে ব্যাসের হিসেবে নির্ধারণ করি, তাহলে আমরা উত্তর গোলার্ধ (Northern Hemisphere) থেকে দক্ষিণ গোলার্ধে (Southern Hemisphere) পৌঁছে যাব।
যদি কোনো সুড়ঙ্গ পৃথিবীর কেন্দ্র অতিক্রম করে যায় তবে কী হবে? যদি আমরা সেই সুড়ঙ্গে ঝাঁপ দিই, তাহলে আমরা ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড² হারে গতিশীল হব এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে কেন্দ্রে পৌঁছাব। কেন্দ্রে পৌঁছাতে প্রায় ২১ মিনিট সময় লাগবে। এই সময় মানুষের গতি ২৮,০০০ কিমি/ঘণ্টা হবে। পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী, যখন মানুষ পৃথিবীর কেন্দ্রে পৌঁছায়, তখন তাদের আচরণ পরিবর্তিত হয় এবং তারা ভরহীন হয়ে যায়। যেখানে সুড়ঙ্গে পড়তে পড়তে কেন্দ্রে পৌঁছানোর পর মানুষের জড়তা মানুষকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য প্রান্তে নিয়ে যাবে। সুড়ঙ্গের অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে তার আরও ২১ মিনিট লাগবে। যখন সে তার গন্তব্যে পৌঁছাবে, তখন তার গতি ২৮,০০০ কিমি/ঘণ্টা থেকে শূন্য হয়ে যাবে। সেই সুড়ঙ্গের বিপরীত বিন্দুকে অ্যান্টিপোড বলা হয়।
অ্যান্টিপোড কী এবং কীভাবে এটি গণনা করবেন?
অ্যান্টিপোড খুঁজে বের করার জন্য সুড়ঙ্গ খননের প্রয়োজন নেই। এটি সুড়ঙ্গের শুরুর ঠিক বিপরীত বিন্দু। এর আরেকটি উদাহরণ হলো, যদি চীনে সুড়ঙ্গের জন্য খনন করা হয়, তাহলে আপনি দক্ষিণ গোলার্ধের আর্জেন্টিনায় অবস্থিত অ্যান্টিপোড পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন।
অ্যান্টিপোড কীভাবে গণনা করবেন? এটা স্পষ্ট যে অ্যান্টিপোড সবসময় পৃথিবীর অন্য গোলার্ধের বিপরীত দিকে থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন ব্যক্তি ৩৫° উত্তর অক্ষাংশে মেমফিসে একটি স্থান বিবেচনা করেন, তাহলে এর অ্যান্টিপোড দক্ষিণ গোলার্ধে ৩৫° দক্ষিণ অক্ষাংশে কোথাও থাকবে।
পৃথিবীর এপার-ওপার সুড়ঙ্গ খনন কি সম্ভব? পৃথিবীতে এক জায়গা থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে অ্যান্টিপোড পর্যন্ত পৌঁছানো আসাম্ভব। এতদূর যাওয়ার জন্য গরম লাভা কোর (core) অতিক্রম করতে হবে। প্রকৌশলগত উন্নতির পরেও, মানুষ বর্তমান সময়ে এমনটা করতে পারে না। তবে, ভবিষ্যতে এটা সম্ভব হতে পারে যে মানুষ সুড়ঙ্গের মাধ্যমে পৃথিবীর মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করার প্রযুক্তি আয়ত্ত করবে। আপনাকে এখানে জেনে অবাক হতে হবে যে, এই সুড়ঙ্গগুলো দিয়ে ভ্রমণ করতে শুধু কম শক্তিই নয়, কম সময়ও লাগবে। কারণ পুরো কাজটি মাধ্যাকর্ষণ দ্বারা করা হবে। এর অর্থ হলো, বিশ্বের অন্য প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য আপনাকে মোটেও শক্তি খরচ করতে হবে না। যেখানে পৃথিবীর ব্যাস অতিক্রম করতে মাত্র ৪২ মিনিট সময় লাগবে।