ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় মৃতদেহ শনাক্তকরণ! কীভাবে কাজ করে ডিএনএ পরীক্ষা জানুন

গুজরাটের আহমেদাবাদে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় গোটা দেশ স্তব্ধ। আহমেদাবাদের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট AI-171 উড্ডয়নের কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয়। এই বিমানে ২৩০ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রু সদস্য সহ মোট ২৪২ জন আরোহী ছিলেন। বিমানটি দুর্ঘটনার পর বি জে মেডিকেল কলেজের হোস্টেল বিল্ডিংয়ে ধাক্কা মারে, যার ফলে হতাহতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়।
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় বহু মৃতদেহের অবস্থা এমন যে তাদের শনাক্ত করা প্রায় আসাম্ভব হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছেন যে, মৃতদের পরিচয় নিশ্চিত করতে প্রায় ১০০০ মানুষের ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। এই পরীক্ষা গুজরাটের ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি এবং ন্যাশনাল ফরেনসিক সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটি’তে সম্পন্ন হবে। এই ডিএনএ পরীক্ষা প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
ডিএনএ (Deoxyribonucleic Acid) হলো একটি জৈব অণু যা প্রতিটি জীবের কোষে পাওয়া যায়। এটি এক ধরণের জেনেটিক কোড যা আমাদের শরীরের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য, যেমন চোখের রঙ, চুলের গঠন, উচ্চতা, এমনকি কিছু রোগের প্রতি সংবেদনশীলতাও নির্ধারণ করে। আমরা আমাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে ডিএনএ উত্তরাধিকার সূত্রে পাই এবং এটি আমাদের পরিচয়ের ভিত্তি। ডিএনএ একটি ডাবল হেলিক্স বা দ্বি-সূত্রক কাঠামোর মতো দেখতে, যা দুটি দীর্ঘ শৃঙ্খল দ্বারা গঠিত। এই শৃঙ্খলগুলি নিউক্লিওটাইডের একক দ্বারা গঠিত। প্রতিটি নিউক্লিওটাইডে তিনটি অংশ থাকে – একটি শর্করা (ডিঅক্সিরাইবোজ), একটি ফসফেট গ্রুপ, এবং চারটি নাইট্রোজেন বেস (অ্যাডেনিন, থাইমিন, সাইটোসিন এবং গুয়ানিন)। এই বেসগুলি নির্দিষ্ট জোড়া তৈরি করে (A সবসময় T এর সাথে এবং C সবসময় G এর সাথে জোড়া তৈরি করে), যা ডিএনএ-এর সিঁড়ির মতো গঠন তৈরি করে।
ডিএনএ-এর প্রধান কাজ হলো জেনেটিক তথ্য সংরক্ষণ করা, যা একটি জীবকে তৈরি এবং পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয়। এটি পিতামাতা থেকে সন্তানদের মধ্যে গুণাবলী স্থানান্তরিত করে এবং কোষগুলিকে প্রোটিন তৈরির নির্দেশ দেয়, যা শরীরের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের জন্য অপরিহার্য। ডিএনএ কোষের নিউক্লিয়াসে ক্রোমোজোম আকারে পাওয়া যায়। মানুষের শরীরে ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে, যা ২৩টি জোড়ায় সাজানো থাকে। এর অর্ধেক মায়ের কাছ থেকে এবং অর্ধেক বাবার কাছ থেকে আসে। প্রতিটি ব্যক্তির ডিএনএ ৯৯.৯% পর্যন্ত একই রকম হলেও, এই ০.১% পার্থক্যই আমাদের একে অপরের থেকে আলাদা করে তোলে এবং আমাদের অনন্য পরিচয় তৈরি করে। এ কারণেই ডিএনএ পরীক্ষা ব্যক্তির পরিচয়, সম্পর্ক নিশ্চিতকরণ এবং অপরাধ তদন্তে ব্যবহৃত হয়।
ডিএনএ পরীক্ষা একটি বৈজ্ঞানিক কৌশল যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো মৃত বা নিখোঁজ ব্যক্তিদের সনাক্তকরণ, পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব পরীক্ষা, অপরাধস্থলে পাওয়া নমুনার মাধ্যমে সন্দেহভাজনকে সনাক্ত করা এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় করা। গুজরাটের এই বিমান দুর্ঘটনায় ডিএনএ পরীক্ষা মৃতদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হচ্ছে, কারণ অনেক মৃতদেহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা পুড়ে যাওয়ায় তাদের চেনা সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে, মৃতদেহের ডিএনএ তাদের নিকটাত্মীয়দের ডিএনএ-র সাথে মিলিয়ে দেখা হবে।
ডিএনএ পরীক্ষার জন্য প্রথমে নিকটাত্মীয়দের প্রমাণ করতে হবে যে তারা মৃতদের ঘনিষ্ঠ। এরপর মুখ থেকে সোয়াব বা রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। মৃতদেহ থেকে নমুনা সংগ্রহের জন্য তাদের দাঁত, হাড়, চুল বা রক্ত ব্যবহার করা হবে। নমুনা সংগ্রহের পর তা ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়, যেখানে ডিএনএ নিষ্কাশন, ডিএনএ পরিবর্ধন (PCR), ডিএনএ প্রোফাইলিং এবং সবশেষে ডিএনএ মিলানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত ৭-১৪ দিন সময় লাগে, তবে জরুরি পরিস্থিতিতে ৩-৫ দিনের মধ্যেও সম্পন্ন করা যেতে পারে। যদিও ডিএনএ পরীক্ষা একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া, তবে এই ক্ষেত্রে সরকার এর খরচ বহন করছে। ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি (FSL) গান্ধী নগর এবং ন্যাশনাল ফরেনসিক সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটি (NFSU) গান্ধী নগরে এই পরীক্ষাগুলি করা হবে। প্রতিটি মৃতদেহের জন্য একাধিক আত্মীয়ের (যেমন বাবা-মা, সন্তান, ভাই-বোন) নমুনা নেওয়া হবে যাতে সঠিক মিল নিশ্চিত করা যায়।