মুখের বুলি ইরানের সমর্থন, আড়ালে কি ইসরায়েল-আমেরিকাকে সমর্থন করছেন অসিম মুনির?

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরের সাম্প্রতিক আমেরিকা সফর এবং জুন ২০২৫-এর ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বলা হচ্ছে যে, তিনি প্রকাশ্যে ইরানের সমর্থন করলেও আড়ালে ইসরায়েল এবং আমেরিকার সঙ্গে রয়েছেন।
এই প্রশ্নটি পাকিস্তানের জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতাকে প্রতিফলিত করে।
স্পষ্টতই, ইসরায়েলের ইরান আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে পাকিস্তান এবং ইরানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ সংসদে মুসলিম দেশগুলিকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একজন ইরানি জেনারেলের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করা হয়েছিল যে, পাকিস্তান ইসরায়েলের উপর পারমাণবিক হামলার হুমকি দিয়েছে, কিন্তু আসিফ তা অস্বীকার করে বলেছেন যে, পাকিস্তানের এমন কোনো উদ্দেশ্য নেই। খাজা আসিফের এই বক্তব্যের পর পাকিস্তানেও এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে, সরকার কী করছে?
এই সময়ে, জেনারেল অসিম মুনির আমেরিকায় ছিলেন, যেখানে তার সফর মে ২০২৫-এর অপারেশন সিন্ধুর (Operation Sindoor)-এর পর ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা ভারসাম্য করতে এবং আমেরিকার কাছে সহায়তা চাইতে ছিল। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠছে যে, মুনিরের আমেরিকা সফর এবং পাকিস্তানের ইরানের সমর্থন কি একটি দ্বৈত নীতির অংশ?
১. যুদ্ধবিরতির পরিস্থিতি থেকে ফায়দা তুলতে চাইছেন মুনির ও পাকিস্তান
আসলে, যুদ্ধবিরতির পরিস্থিতি থেকে ফায়দা তোলার চেষ্টায় মুনির আমেরিকা সফর করছেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মে ২০২৫-এ অপারেশন সিন্ধুর-এর পর উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়, যেখানে ভারত পাকিস্তান এবং পিওকে (PoK)-তে সন্ত্রাসী আস্তানা ধ্বংস করে। এর পর ১০ মে উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন যে, মধ্যস্থতায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই যুদ্ধবিরতি থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির ফায়দা পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনির এবং পাকিস্তান নিতে চাইছেন।
যুদ্ধবিরতি পাকিস্তানকে তার সামরিক ও কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার সুযোগ দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, মুনির ভারতের সঙ্গে উত্তেজনাকে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে এবং সেনাবাহিনীর আধিপত্য বাড়াতে ব্যবহার করছেন। পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে মুনির যুদ্ধবিরতিকে ইমরান খানের মতো বিরোধীদের চুপ করাতে এবং সেনাবাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে ব্যবহার করছেন।
২. চীনকে ঘিরে ফড়ার জন্য আমেরিকা আবারও পাকিস্তানের ভেতরে প্রবেশ করতে চাইছে
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আধিপত্য নিয়ে আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়ায় তার কৌশলকে আবারও শক্তিশালী করার জন্য পাকিস্তানের প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে, পাকিস্তান, যা চীনের নিকটতম মিত্র, আমেরিকার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চল হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)-এর কারণে। আমেরিকা চীনকে ঘিরে ফাড়ার জন্য পাকিস্তানে আবারও প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তান এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে। পাকিস্তান এই বিষয়টি বোঝে যে, ইরানের পাশে থাকলে আমেরিকার সাহায্য পাওয়া থেকে তারা বঞ্চিত হবে।
পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে এটি মধ্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়াকে সংযুক্ত করে। এই কারণেই আমেরিকার জন্য পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। CPEC, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর অংশ, পাকিস্তানকে চীনের কৌশলগত অংশীদার বানিয়েছে। আমেরিকা এই প্রভাব কমাতে পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রবেশাধিকার বাড়াতে চাইছে।
৩. ইরানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের জন্য আমেরিকার পাকিস্তানের প্রয়োজন
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ (জুন ২০২৫)-এর পর, যেখানে ইসরায়েল অপারেশন রাইজিং লায়ন (Operation Rising Lion)-এর অধীনে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে, সেখানে আমেরিকারও আগ্রহ রয়েছে। ইরান-এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপের জন্য আমেরিকার পাকিস্তানের প্রয়োজন বেশ কিছু কৌশলগত কারণে। ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত এবং বালুচিস্তানের কৌশলগত গুরুত্ব এটিকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের জন্য আমেরিকার পাকিস্তানি আকাশসীমা এবং সামরিক ঘাঁটির প্রয়োজন। এটি আফগানিস্তান যুদ্ধে (২০০১-২০২১) দেখা গেছে, যখন পাকিস্তান আমেরিকাকে আকাশসীমা এবং লজিস্টিক সহায়তা দিয়েছিল।
পাকিস্তান ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকাকে আঞ্চলিক গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছে। হিজবুল্লাহ এবং হুতিদের মতো ইরানের প্রক্সি গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে পদক্ষেপে পাকিস্তানের গোয়েন্দা তথ্য কার্যকর হতে পারে।
৪. দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকার ‘নেগেটিভ লিস্ট’ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মরিয়া পাকিস্তান
এক সময় পাকিস্তান আমেরিকার প্রিয়পাত্র ছিল। যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতে আসতেন, তাহলে তাদের পাকিস্তানেরও সফর হতো। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে পাকিস্তান বিশ্ব কূটনীতির প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে। অনেক দিন পর পাকিস্তানের কাছে সুযোগ এসেছে আবারও আমেরিকার প্রিয়পাত্র হওয়ার। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেতিবাচক তালিকা, বিশেষ করে ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (FATF)-এর ধূসর তালিকা এবং সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত অন্যান্য পর্যবেক্ষণ তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সংগ্রাম করছে। আমেরিকার সহায়তায় তারা এই সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে পারে। স্পষ্টতই, ইরানকে এড়িয়ে চলাই পাকিস্তানের জন্য মঙ্গলজনক।