ফোরদো প্ল্যান্ট: পাহাড়ের ৩০০ ফুট নিচে ইরানের পারমাণবিক ঘাঁটি, ইসরায়েলি বোমা ভেদ করতে পারবে না

সুন্দর উপত্যকা, সবুজ পাহাড় এবং পাথরের একেবারে গভীরে একটি বাঙ্কারে অবস্থিত ইরানের ফোরদো (Fordo) নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট হলো তার সবচেয়ে গোপন পারমাণবিক ঠিকানা। প্রায় ৩০০ ফুট পুরু পাথরের স্তরের নিচে অবস্থিত এই পরমাণু সাইটে ইসরায়েলি বোমারও কোনো প্রভাব পড়ে না।
ইসরায়েল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ (Operation Rising Lion) এর অধীনে ইরানের নাতাঞ্জ (Natanz) পরমাণু সাইটের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ইসরায়েলি হামলায় সেখানকার ১৫০০০ সেন্ট্রিফিউজ (centrifuges) ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরায়েল ফোরদো প্ল্যান্টেও হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু আইএইএ (IAEA) অনুসারে, এটি সীমিত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
ইসরায়েলের এটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার ক্ষমতা নেই। এই প্ল্যান্টটি ধ্বংস না করে ইসরায়েল ইরানকে পরমাণু শক্তিবিহীন করার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ইসরায়েল আমেরিকার কাছে GBU-57 বাঙ্কার বাস্টার বোমা (GBU-57 Bunker Buster Bomb) এবং B-2 বোমারু বিমান (B-2 Bomber) এর দাবি করছে। কিন্তু এমনটা করার অর্থ হবে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে আমেরিকার সরাসরি প্রবেশ। আমেরিকা কি এমনটা করতে প্রস্তুত হবে?
কোথায় এবং কেমন ইরানের অভেদ্য পারমাণবিক সাইট ফোরদো?
সিএনএন (CNN) বলছে, পাহাড়ের একটি গুচ্ছে তৈরি পাঁচটি সুড়ঙ্গ, সহায়তার জন্য একটি বড় কাঠামো এবং একটি বিশাল নিরাপত্তা বেষ্টনী। সম্প্রতি উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি থেকে আপনি ইরানের রহস্যময় ফোরদো ফিউয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট (FFEP) সম্পর্কে কেবল এতটুকুই দেখতে পাবেন।
আসলে এর পরের সমস্ত কিছু পাহাড়ের গর্ভে লুকানো সুড়ঙ্গগুলিতে রয়েছে।
ধর্মীয় শহর কোম (Qom)-এর কাছে অবস্থিত এই গোপন, অত্যন্ত সুরক্ষিত কমপ্লেক্সটি ২০০৯ সালে প্রথম জনসমক্ষে আসে যখন পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এটি প্রকাশ করে। এটি প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এই প্ল্যান্টটি পাহাড়ের গভীরে প্রায় ৮০-৯০ মিটার (প্রায় ৩০০ ফুট) গভীরতায় নির্মিত।
ফোরদো উপত্যকার চিত্র (ছবি- উইকিপিডিয়া)
এর ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম সুরক্ষা প্রদান করে, কারণ এটি আকাশপথে হামলা এবং প্রচলিত বোমা হামলা থেকে প্রায় অভেদ্য।
সিএনএন বলছে, আমরা এর সম্পর্কে যা কিছু জানি, তার একটি বড় অংশ ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলি দ্বারা বহু বছর আগে চুরি করা ইরানি নথিপত্রের ভাণ্ডার থেকে এসেছে।
এর প্রধান হলটি মাটি থেকে ৮০ থেকে ৯০ মিটার (প্রায় ২৬২ থেকে ২৯৫ ফুট) নিচে রয়েছে। এর ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে ইসরায়েলের কাছে থাকা যেকোনো আকাশ বোমা থেকে সুরক্ষিত রাখে, যার ফলে আকাশ থেকে এটিকে ধ্বংস করা প্রায় আসাম্ভব কাজ হয়ে দাঁড়ায়।
কিছু বিশ্লেষক বলছেন যে, ফোরদোই সেই জায়গা যেখানে ইরান এনরিচড ইউরেনিয়াম (enriched uranium) স্টককে পারমাণবিক বোমায় রূপান্তর করতে দ্রুত কাজ করতে পারে। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলি বিশ্বাস করে যে, যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় তবে ফোরদো হবে তার প্রাথমিক কেন্দ্র। এর গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা এটিকে ইসরায়েল এবং আমেরিকার জন্য একটি বড় হুমকি করে তুলেছে।
ফোরদো নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের চিত্র (ছবি- এএফপি)
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে ফোরদোতে উন্নত সেন্ট্রিফিউজ মেশিন (centrifuge machines) রয়েছে, যা ৬০% পর্যন্ত বিশুদ্ধতা সহ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করতে পারে। পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য ইউরেনিয়ামকে ৯০% পর্যন্ত বিশুদ্ধ করার প্রয়োজন হয়, ফোরদো ৬০ শতাংশ ক্ষমতা অর্জন করেছে। যদি ফোরদো প্ল্যান্ট তার ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করে তবে সে পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হবে।
এ কারণেই পশ্চিমা দেশগুলি এবং ইসরায়েল-আমেরিকা এটিকে হুমকি হিসেবে দেখে।
আমেরিকার আছে ফোরদো ধ্বংস করার ক্ষমতা
ইসরায়েলের কাছে ফোরদো নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ধ্বংস করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু আমেরিকার কাছে এই শক্তি আছে। কিন্তু আমেরিকা এখনও এই যুদ্ধে নামেনি। সিবিএস নিউজ (CBS News)-এর রিপোর্ট অনুসারে, আমেরিকা এই যুদ্ধে নামার কথা ভাবছে। সিবিএস নিউজ মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে যে, আমেরিকা এই যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এবং যদি তারা এমনটা করে, তবে তাদের প্রধান লক্ষ্য ফোরদো নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টই হবে।
ম্যাসিব অর্ডন্যান্স পেনট্রেইটর GBU-57 কী?
মার্কিন প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা মাটির নিচে থাকা এমন গভীর বাঙ্কার ভাঙার জন্য বাঙ্কার বাস্টার বোমা (Bunker Buster Bomb) তৈরি করেছেন। এটিকে ম্যাসিব অর্ডন্যান্স পেনট্রেইটর (Massive Ordnance Penetrator – MOP) বলা হয়। আমেরিকা তাদের এই বাঙ্কার বাস্টারকে GBU-57 নাম দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, GBU-57 হলো মার্কিন অস্ত্রাগারের সবচেয়ে শক্তিশালী অ-পারমাণবিক “বাঙ্কার-বাস্টার” বোমা, যা বিশেষভাবে গভীর গর্তে চাপা এবং ভারী সুরক্ষিত শত্রুর ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের (Washington Post) একটি রিপোর্ট অনুসারে, মার্কিন বাঙ্কার-বাস্টারের ওজন ১৩,৬০০ কেজি হয়। এই বোমা তার উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়েই পৃথিবীকে ২০০ ফুট ভেদ করে লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করত। এখন এর ক্ষমতা আরও বেড়েছে। এই বোমা জিপিএস (GPS) দ্বারা পরিচালিত হয় এবং ঠিক তার লক্ষ্যবস্তুতেই আঘাত করে।
এই বোমা কঠিন ইস্পাত মিশ্র ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়, যা বিস্ফোরণের আগে কঠিন স্তর ভেদ করার জন্য ডিজাইন করা হয়।
বাঙ্কার বাস্টার GBU-57 শুধুমাত্র বিশেষ বিমানের মাধ্যমে নিক্ষেপ করা যেতে পারে। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র বি-২ স্পিরিট স্টিলথ বোমারু বিমান (B-2 Spirit Stealth Bomber)-ই এমওপি বহন এবং স্থাপন করতে পারে। আমেরিকার ১৯টি বি-২ বিমান রয়েছে। বি-২ বিমান আকাশে জ্বালানি ভরার সাথে দীর্ঘ পাল্লার মিশনে সক্ষম। রিপোর্ট অনুসারে, এখন পর্যন্ত প্রকৃত যুদ্ধে এর ব্যবহার করা হয়নি।