ইজরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, ভারতীয় কর্মীদের রাতের আশ্রয় বাঙ্কারে! উদ্বিগ্ন পরিবার

ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাতের আঁচ এবার সেখানকার ভারতীয় শ্রমিকদের পর্যন্ত পৌঁছেছে, যারা সেখানে জীবিকার সন্ধানে গিয়েছিলেন। উভয় পক্ষ থেকে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জেরে ইজরায়েলে কর্মরত ভারতীয়দের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ওয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে এনবিটি-র সঙ্গে কথা বলে বেশ কিছু কর্মী জানিয়েছেন যে, দিনের বেলায় কাজ করলেও রাত কাটাতে হচ্ছে বাঙ্কার এবং সেফটি কন্টেনারে। রাতের বেলা ঘনঘন সাইরেনের শব্দ শোনা যায়।
এই হামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ভারতে থাকা তাদের পরিবারের সদস্যরা। ভিডিও কলে যখন ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন হামলার দৃশ্য দেখা যায়, তখন তাদের বুক কেঁপে ওঠে বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। তেল আভিভ থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে কারমেলের একটি স্থানে উত্তরপ্রদেশের ৫২ জন শ্রমিকের একটি দল অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে আমেঠির বাসিন্দা সঞ্জয়, যিনি একজন টাইলস কারিগর, ওয়াটসঅ্যাপ কলে জানিয়েছেন যে দিনের বেলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে এবং সবাই কাজ করে। কিন্তু রাতের পরিস্থিতি লোমহর্ষক।
রাতে হামলার সময় হঠাৎ সাইরেন বেজে উঠলে মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে সেফটি কন্টেনার বা বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হয়। বেশিরভাগ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কিন্তু যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত ড্রোনের টুকরা নিচে পড়ে, তখন যে শব্দ হয় তা হৃদয়বিদারক। হরিয়ানার প্রমোদও তেল আভিভে আছেন। তার বন্ধু গিরিশ জানিয়েছেন যে প্রমোদসহ অনেকেই সেখানে আছেন এবং দিনের বেলায় তাদের সাথে একবার ওয়াটসঅ্যাপ কলে কথা হয়। সবাই দিনের কাজ শেষে বাঙ্কারে রাত কাটান। পরিস্থিতি দেখে প্রতিটি কর্মী দেশে ফিরতে ব্যাকুল। এছাড়া, আম্বেদকরনগরের সুরেন্দ্র, যিনি একজন লোহা নির্মাণ শ্রমিক, ইজরায়েলে রয়েছেন। তার ছেলে অনুজ জানিয়েছেন যে বুধবার সকালে ওয়াটসঅ্যাপ কলে বাবার সাথে কথা হয়েছে এবং তিনি সুস্থ আছেন।
কারমেলের বাসিন্দা আম্বেদকরনগরের রামবৃক্ষ ওয়াটসঅ্যাপ কলে জানিয়েছেন যে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলি বাঙ্কারের ওপর দিয়ে উড়ে যায় এবং তার শব্দ এতটাই জোরালো যে তা শুনেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। ড্রোন যখন একসাথে আসে, তখন মনে হয় যেন তারার ঝাঁক আসছে। বেশিরভাগ ড্রোন কাছাকাছি আসার আগেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। সেগুলোর টুকরা ঝনঝন শব্দে আকাশ থেকে নিচে পড়ে। এগুলো থেকে বাঁচতে বাঙ্কার এবং সেফটি কন্টেনারে থাকতে হয়। ইজরায়েলে পাঠানো শ্রমিকদের দৃষ্টি এখন ভারত সরকারের দিকে। তারা সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। শ্রমিক অজয় জানিয়েছেন যে সরকার যদি কোনো তথ্য দেয়, তবে তা যেন তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেছেন যে, ইজরায়েলের বাইরের এলাকার প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টে সেফটি কন্টেনার তৈরি করা হয়েছে এবং কর্মীদের সেখানেই রাখা হয়। আগ্রার বাসিন্দা রাজকুমার, যিনি ইজরায়েলে বিমানের যন্ত্রাংশ তৈরির একটি কো ম্পা নিতে কাজ করতেন, এক মাস আগেই ফিরে এসেছেন। তিনি জানান যে হামলার পূর্বাভাস ছিল এবং পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছিল না। ব্যক্তিগত সমস্যার কারণেও তাকে ফিরতে হয়েছে। একইভাবে আগ্রার গিরিশও ফিরে এসেছেন, তবে তেল আভিভে থাকা বন্ধুদের জন্য তিনি চিন্তিত।
বারাবাঁকির দেবা এলাকার বিনোবাগ্রামের বাসিন্দা ৩০ বছর বয়সী রাজু সিং জেরুজালেমে ভবন নির্মাণের কাজ করেন। তার স্ত্রী জসোমতি জানান যে ভিডিও কলে স্বামীর সাথে কথা বলার সময় সাইরেন বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শব্দ শুনে তার মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তার বাবা মানিকচন্দ্র জানান যে জেরুজালেমে রাজুসহ অন্যদের সুরক্ষার জন্য বাঙ্কার রয়েছে। হামলার দুই মিনিট আগে সাইরেন বাজে অথবা মোবাইলে মেসেজ আসে। রাজু জানিয়েছেন যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই তিনি দেশে ফিরতে পারবেন।
বিনোবাগ্রামের ৩০ বছর বয়সী তেজ বাহাদুর সিং ইজরায়েলে ওয়েল্ডিং কারিগর হিসেবে কর্মরত। তার স্ত্রী বিন্দেশ্বরী জানান যে এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল এবং প্রতি মাসে তার অ্যাকাউন্টে দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকা আসত। কিন্তু গত পাঁচ দিন ধরে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। দুই দিন আগে তার ছেলে ফোন করে জানিয়েছিল যে, সে যে বাঙ্কারে ছিল, তার উপরের ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে এবং সেও তাতে আটকে পড়েছিল। পরে তাকেসহ অন্য শ্রমিকদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়। বিন্দেশ্বরী বলেন যে স্বামীর কাছ থেকে যা জানতে পারছেন, তাতে তিনি ভয় পাচ্ছেন।
বিনোবাগ্রামের ৩০ বছর বয়সী সান্তরারাম ১৩ মাস ধরে ইজরায়েলে টাইলস কারিগর হিসেবে কাজ করছেন। ভিডিও কলে তিনি জানান যে বর্তমানে জেরুজালেমে বেশি হামলা হচ্ছে। বেশিরভাগ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে ধ্বংস করা হলেও, কিছু না কিছু ক্ষতি হচ্ছেই। সান্তরারাম জেরুজালেম থেকে কিছুটা দূরে রেহাদ শহরে এসেছেন। সেখানে প্রতিদিন আট ঘণ্টা কাজ করে তিনি প্রতি মাসে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা পান। দুই ঘণ্টা ওভারটাইম করলে আরও ৫০ হাজার টাকা আয় হয়। খাবার এবং রুম ভাড়া বাবদ প্রায় ২৫০০০ টাকা খরচ হয়। তাই ঝুঁকি থাকলেও আয় প্রচুর। সান্তরারাম আরও জানান যে আগে বাঙ্কারের সংখ্যা কম থাকলেও এখন বেশিরভাগ নতুন ভবনে বাঙ্কার তৈরি করা হচ্ছে।
১৩ মাস আগে বারাবাঁকির দেবা এলাকার বিনোবাগ্রাম, জগদীশপুর এবং আটাকহাইয়া গ্রাম থেকে ৫৫ জন কর্মী ইজরায়েল গিয়েছিলেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত ৬,৬৯৪ জন ভারতীয় কর্মী ইজরায়েলে পাঠানো হয়েছে। তারা ১৯৫টি ইজরায়েলি কো ম্পা নির জন্য কাজ করছেন, যার মধ্যে ২,৩৪৮ জন ভবন নির্মাণ কারিগর, ১,৯৫৫ জন লোহা মোড়ানো কারিগর, ১,৬০০ জন প্লাস্টার কারিগর এবং ৭৯১ জন টাইলস কারিগর রয়েছেন।