আরব-মঙ্গোল থেকে ইরাক পর্যন্ত: ইরানের যুদ্ধজয় ও পরাজয়ের সম্পূর্ণ ইতিহাস, ইসরায়েলের সাথে সংঘাতের আবহে জানুন

ইরানের যুদ্ধের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। বহুবার তারা হেরেছে, আবার বহুবার জিতেছে। অনেক সময় যুদ্ধবিরতির মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এই দেশটি শুধু যুদ্ধই লড়ে গেছে। ইতিহাসের পাতা ইরানের যুদ্ধে ভরা। এখন যখন ইরান আবারও ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, তখন এই পাতাগুলো নতুন করে উল্টানো হচ্ছে। অনেক মজার গল্পও সামনে আসছে। প্রাচীন পারস্য, যা আজ আমরা ইরান নামে জানি, অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। এই কারণেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন শক্তির নজর এর উপর ছিল। এই কারণে আরব থেকে মঙ্গোল পর্যন্ত, ইরান অসংখ্য যুদ্ধ লড়েছে। কখনো আক্রমণকারীর ভূমিকায়, আবার কখনো রক্ষকের ভূমিকায়। ইসলামিক বিপ্লবের আগেও এই যুদ্ধগুলি চলেছে এবং ইসলামিক বিপ্লবের পর ক্ষমতা পরিবর্তনের পরেও ইরান যুদ্ধ করেছে, আর এখন ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ করছে।
আরবদের সাথে চারটি যুদ্ধের পর ইরানের সাসানিদ সাম্রাজ্যের পতন
সপ্তম শতাব্দীর ঘটনা। ইরানে সাসানিদ সাম্রাজ্য ছিল। এই সাম্রাজ্যের ব্যাপক প্রভাব ছিল। তখন আরবদের নজর পড়ে এবং তারা আক্রমণ করে। একের পর এক অনেক যুদ্ধ লড়ার পর সাসানিদ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং ইরানে ইসলামিক শাসনের ভিত্তি স্থাপিত হয়। আরবদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইসলামিক শাসন, রাশিদুন খিলাফত এই হামলাগুলি চালায়। এই সময় এবং এর আগে-পরে অনেক যুদ্ধ লড়া হয়েছিল। প্রধান যুদ্ধগুলির মধ্যে একটি হল ব্যাটেল অফ ধী কার (Battle of Dhi Qar), যা সাসানিদ সাম্রাজ্য এবং আরবদের মধ্যে হয়েছিল। এই যুদ্ধে সাসানিদ সাম্রাজ্যকে পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এতে আরবদের মনোবল বেড়ে গিয়েছিল। আরেকটি যুদ্ধ ব্যাটেল অফ আল-কাদিসিয়াহ (Battle of al-Qadisiyyah) নামে পরিচিত। এটি বর্তমানে ইরাকের কুফার কাছের একটি জায়গা ছিল। সেই সময় পারস্যের সেনাপতি রুস্তুম ফাররুখজাদ এবং আরবের সেনাপতি সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাসের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। এতে সাসানিদ সাম্রাজ্যকে ব্যাপক পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয়। তাদের রাজধানী কেটেসিফোন (Ctesiphon) এর পতন ঘটে। এই যুদ্ধকে সিদ্ধান্তমূলক বলে মনে করা হয় এবং এখান থেকেই সাসানিদ সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয়। কেটেসিফোনের পতনের পর পারস্যবাসী অর্থাৎ সাসানিদ সাম্রাজ্য তাদের অবশিষ্ট শক্তি একত্রিত করে এবং আবারও সরাসরি যুদ্ধ হয়। ইতিহাসে এটি ব্যাটেল অফ জালুলা (Battle of Jalula) নামে পরিচিত। এবার আরবদের উত্তর ইরাকে দখল হয়। অর্থাৎ পারস্যের শাসকদের পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয়। পশ্চিম ইরানেও একটি যুদ্ধ হয়েছিল। এটি ব্যাটেল অফ নাহাভান্ড (Battle of Nahavand) নামে পরিচিত। এবার পারস্যের সেনাপতি ফিরোজান এবং আরবের সেনাপতি নুমান ইবন মুকরিন তাদের সৈন্যদের নিয়ে মুখোমুখি হন। এর পরেই সাসানিদ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। শেষ সাসানিদ সম্রাট ছিলেন ইয়াজদেগার্দ-III (Yazdegerd-III), যিনি যুদ্ধের পরেও পালিয়ে বেড়ান এবং শেষ পর্যন্ত নিহত হন। ঘটনাটি ৬৫১ খ্রিস্টাব্দের।
শিয়া সম্প্রদায়ের বিকাশ এবং তুর্কী ও মঙ্গলদের আধিপত্য
এর পর ইসলামিক খিলাফতের বিস্তার ঘটে। খলিফা উমরের শাসনামলে ইসলামের বিস্তার ও আঞ্চলিক বিস্তার ক্রমাগত চলতে থাকে। ইসলামিক ঐক্য ও ধর্মের নামে যুদ্ধ চলতে থাকে। ধীরে ধীরে পারস্য সংস্কৃতি অনুসরণকারীরা ইসলামকে আত্মস্থ করতে শুরু করে। এর ফলে পারস্য ভাষা, সাহিত্য এবং প্রশাসন ইসলামিক যুগে নতুন জীবন লাভ করে। এভাবে ইরানে শিয়া ইসলামের বিকাশ ধীরে ধীরে হয়, যা পরে ইসলামিক বিশ্বে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করতে সক্ষম হয়। আজ শিয়া সম্প্রদায় সারা বিশ্বে বসবাস করে। বর্তমান ইরান এবং এর সর্বোচ্চ নেতা খোমেনি এই শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতাও।
তুর্কীদের দ্বারা ক্ষমতা দখল:
একাদশ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে ইরানে বুয়িদ (Buyid) এবং গজনভিদের মতো শাসক শক্তি ছিল, যারা ইসলামিক হলেও পারস্য সংস্কৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। এই সময় ধীরে ধীরে তুর্কী, বিশেষ করে সেলজুকদের প্রভাব মধ্য এশিয়ায় বৃদ্ধি পায়, যারা ধীরে ধীরে ইসলামিক বিশ্বের নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেলজুক তুর্করা একটি সুন্নি মুসলিম উপজাতি ছিল, যারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং খলিফার বৈধতা স্বীকার করে ক্ষমতা বিস্তার করে। ধীরে ধীরে তারা ইরান, ইরাক, সিরিয়া এবং তুরস্ক পর্যন্ত তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে। এই সময় ইরানে পারস্যের শাসকদের সরিয়ে সেলজুকরা ক্ষমতা লাভ করে। প্রায় ১০৪০ সালের দিকে বুয়িদ রাজবংশের পতন ঘটে। সুন্নি তুগরুল বেগ (Tughril Beg) বাগদাদে গিয়ে আব্বাসীয় খলিফা থেকে “সুলতান” উপাধি গ্রহণ করেন। এরপর তাদের উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। সেলজুক তুর্করা ব্যাটেল অফ দন্দানাকান (Battle of Dandanaqan)-এ গজনভী শাসক মাসুদকে পরাজিত করে। এর পর তারা খোরাসান এবং ইরানের বড় অংশের উপর অধিকার লাভ করে। সেলজুকরা পারস্য ভাষাকে দরবারের ভাষা হিসেবে বজায় রাখে। ওমর খৈয়াম, আল-গাজ্জালি এবং নিজাম আল-মুলকের মতো পণ্ডিতরা এই যুগে আবির্ভূত হন। এই সমস্ত যুদ্ধের ফলস্বরূপ সুন্নি শাসকরা পারস্য ঐতিহ্যের সাথে ইসলামিক-তুর্কী শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তারা পারস্য সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেনি, বরং তা গ্রহণ করেছিল। তারা মাদ্রাসা, স্থাপত্য এবং ইসলামিক দর্শনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করে। ইতিহাসে এই সময়কে পারস্য-ইসলামিক সংস্কৃতির স্বর্ণযুগও বলা হয়।
চেঙ্গিস খানের যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা:
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে মঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খানের নজর এই অঞ্চলের উপর পড়ে। ১২১৯ থেকে ১২৬০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতি এবং বাণিজ্যিক পথের উপর দখলের উদ্দেশ্যে চেঙ্গিস খান আক্রমণ শুরু করেন। সেই সময় ইরানের উপর খাওয়ারিজম শাহী সাম্রাজ্য রাজত্ব করছিল। অনেক শহর ধ্বংস হয়ে যায়। বিপুল সংখ্যক মানুষ নিহত হয়। নিশাপুর নামক স্থানে তো এক লক্ষেরও বেশি মানুষের গণহত্যা হয়।