ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে মুসলিম দেশগুলো দ্বিধাগ্রস্ত কেন? কিসের ভয় তাদের?

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। ইসরায়েল প্রথমে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এছাড়াও ইসরায়েল ইরানের অনেক বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এরপর মুসলিম দেশগুলো সম্মিলিতভাবে ইসরায়েলের নিন্দা জানালেও, কেউই শক্তভাবে ইরানের পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না। কেবল পাকিস্তানই মুসলিম দেশগুলোকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আসার আহ্বান জানিয়েছে। ইরান তো এমনও দাবি করেছিল যে, ইসরায়েল যদি পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করে, তাহলে এর জবাব পাকিস্তান দেবে। যদিও পাকিস্তান দ্রুত এই দাবি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। এমনকি সে ইরান সংলগ্ন সীমান্তও বন্ধ করে দেয়। এতে পাকিস্তানের দ্বৈত নীতিও সামনে আসে। বিশ্বের বেশিরভাগ মুসলিম দেশেরও একই নীতি। সৌদি আরব, কাতারসহ প্রায় ২১টি মুসলিম দেশ ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করেছে, কিন্তু কেউই খোলাখুলি ইরানের সমর্থন করতে রাজি নয়।
পারস্পরিক মতবিরোধ ও ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক
মুসলিম দেশগুলো নিজেদের মধ্যে কখনোই ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে মতবিরোধ শেষ হয়নি। এমন অনেক মুসলিম দেশও আছে যারা ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ। সৌদি আরবের মতো দেশগুলো আমেরিকার ঘনিষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে আমেরিকা ইসরায়েলের সমর্থক। এমন পরিস্থিতিতে অনেক মুসলিম দেশ চায় না যে তাদের আমেরিকার সাথে দূরত্ব তৈরি হোক। ইরান ইসলামিক বিপ্লবের আগে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থক ছিল। আমেরিকার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। ইরানে যখন ইসলামিক বিপ্লব হয়, সেই বছরই মিশর ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর জর্ডানও ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। গত পাঁচ বছরে ইসরায়েলের সাথে মরক্কো, সুদান, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতেরও কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এই মুসলিম দেশগুলো হঠাৎ করে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে এত বড় পরিবর্তন আনতে পারে না।
শিয়া-সুন্নি মতভেদ এবং আমেরিকার প্রভাব
মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার একটি বড় কারণ শিয়া ও সুন্নির মধ্যে মতভেদও। ইরান একটি বড় শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। অন্যদিকে সৌদি আরবসহ বেশিরভাগ মুসলিম দেশ সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ। আজারবাইজান শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ। তুরস্কের মতো দেশগুলো যদিও অন্য মুসলিম দেশগুলোকে ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পরামর্শ দেয়, তবে তাদের নিজেদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ইসরায়েলের সাথে বজায় আছে। অন্যদিকে তুরস্ক ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সমর্থন করে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তান শুধুমাত্র ভারতের সাথে উত্তেজনার কারণে এই মুহূর্তে ইরানকে গুরুত্ব দিচ্ছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই তারা তুরস্ক ও ইরানের ঘনিষ্ঠ ছিল। যদিও মাঝে তার ঘনিষ্ঠতা আফগানিস্তানের সাথে বেড়েছিল। এখন পরিস্থিতি এমন যে, তার আফগানিস্তান এবং ভারত উভয় প্রতিবেশীর সঙ্গেই উত্তেজনা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সে নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করার জন্য ইরানের সমর্থনে আওয়াজ দিচ্ছে।
আরব দেশগুলোতে আমেরিকার যথেষ্ট প্রভাব আছে। উপসাগরীয় দেশগুলোতে আমেরিকার হাজার হাজার সৈন্য এবং সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। আমেরিকা খোলাখুলি ইসরায়েলকে সমর্থন করছে। ইসরায়েলের কাছে যে সমস্ত মার্কিন অস্ত্র পৌঁছাচ্ছে, তা কোনো না কোনো মুসলিম দেশের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও জর্ডানের মতো দেশগুলো এর বিরোধিতা করতে পারছে না। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগে আরব দেশগুলো ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করত। তবে এই যুদ্ধের পর এখন এই ইস্যুতে কেবল ইরান সমর্থিত কিছু সংগঠনই হস্তক্ষেপ করে। তাদেরও আমেরিকা সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে গণ্য করেছে। এর মধ্যে হিজবুল্লাহ এবং হামাসের মতো সংগঠন রয়েছে। কাতারের মতো দেশে আমেরিকার ঘাঁটি রয়েছে। আমেরিকা যখন ইচ্ছা তা ব্যবহার করতে পারে। আরব দেশগুলোর সাথে আমেরিকার কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে।
আমেরিকা যখন ইরাকে হামলা চালায়, তখন ইরান এর বিরোধিতা করেনি। সাদ্দাম হুসেনের ফাঁসি হয়ে গেলেও ইরান এর বিরুদ্ধে একটি শব্দও বলেনি। ওআইসি (OIC) এবং আরব লীগ (Arab League)-এর মতো সংগঠনগুলোও মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে সফল হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে ইরানকে বিচ্ছিন্ন দেখাচ্ছে। যদি আমেরিকার সাথেও মতবিরোধ বাড়ে, তাহলে আমেরিকা ও ইসরায়েল একসাথে ইরানের উপর হামলা চালাবে এবং তখন তার জন্য বড় সমস্যা তৈরি হবে। সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত সরকার ছিল, কিন্তু তুরস্কের সাহায্যে এই সরকারকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম দেশগুলোর পারস্পরিক মতভেদই তাদের একসাথে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার সমর্থন ছোট ছোট মুসলিম দেশগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিয়া ও সুন্নি মতভেদের কারণে ইসরায়েলের হামলাকে ইসলামের বিরুদ্ধে হামলাও প্রমাণ করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ইসলামিক দেশগুলোর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আসাম্ভবই মনে হচ্ছে।