পারস্য থেকে ইরান হওয়ার গল্প এবং ইসরায়েলি আক্রমণে ভারতের নীরবতা!

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে ভারতের ‘নিরপেক্ষতা’ স্পষ্টভাবে ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ভারত ও ইরানের সম্পর্ক হাজার হাজার বছরের পুরনো। ইরানের নামই ‘আর্যদের দেশ’, এবং প্রাচীনকালে আর্যদের একটি শাখা বেদ রচনা করেছিল।
ভারতেরও একটি নাম ছিল ‘আর্যাবর্ত’। যখন পাকিস্তানের অস্তিত্ব ছিল না, তখন ভারত ও ইরান প্রতিবেশী দেশ ছিল। দু’দেশের শুধু সীমানাই নয়, হাজার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক সম্পর্কও ছিল। কিন্তু মনে হচ্ছে, মোদি সরকার ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক ভাষার সঙ্গে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, যারা ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এটি ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে সর্বদা বিদ্যমান নৈতিকতার অবলুপ্তির ইঙ্গিত।
১৩ জুন ২০২৫-এ ইসরায়েল হঠাৎ ইরানের উপর আক্রমণ করে, যখন ১৫ জুন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির উপর চুক্তি আলোচনার পরবর্তী পর্ব নির্ধারিত ছিল। ইরান পাল্টা আক্রমণ করে, এবং যদিও তারা ইসরায়েলকে সমান ক্ষতি করতে পারেনি, তবে এতটুকু ক্ষতি অবশ্যই করেছে যে ইসরায়েলের অহংকার ভেঙে যায়। ইসরায়েলের পেছনে আমেরিকার শক্তি রয়েছে, এবং উভয়ই খামেনির হত্যার হুমকি দিচ্ছে। এটি কূটনৈতিক ইতিহাসের এক লজ্জাজনক ঘটনা, যেখানে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের হত্যার কথা প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে।
ইরানের প্রাচীন ইতিহাস
ইরানের লিখিত ইতিহাস ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু হয়, যখন এলাম সভ্যতা সুসাকে তাদের রাজধানী বানিয়েছিল। সুসা একটি প্রধান বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল, যা মেসোপটেমিয়ার সাথে বাণিজ্য করত এবং প্রোটো-এলামাইট লিপি ব্যবহার করত, যা বিশ্বের প্রথম দিকের লিপিগুলির মধ্যে একটি। ইরানের নাম আবেস্তান শব্দ ‘এর্যনাম’ থেকে এসেছে, যার অর্থ “আর্যদের ভূমি।” গ্রীকরা এটিকে পার্সিয়া বলত, যা পার্স প্রদেশ থেকে নেওয়া হয়েছিল।
আবেস্তা জরাথুস্ট্রীয় ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ, যা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে বেদের সাথে যুক্ত। উভয় ক্ষেত্রেই অগ্নি পূজা এবং যজ্ঞের ঐতিহ্য ছিল। জরাথুস্ট্র (১৫০০-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), জরাথুস্ট্রীয় ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যিনি এই অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন এবং বহু-ঈশ্বরবাদের বিরুদ্ধে একেশ্বরবাদের প্রচার করেন। তার শিক্ষা অহুরা মাজদা (সর্বোচ্চ ঈশ্বর) কে কেন্দ্র করে ছিল, এবং তার বার্তা ছিল: “ভালো মানুষ হও, সৎ জীবনযাপন করো।” তার অনুসারীরা আজ পার্সি নামে পরিচিত। আরবরা যখন ইরান জয় করে, তখন পার্সিরা ভারতে পালিয়ে আসে এবং তাদের পবিত্র অগ্নি আজও তাদের মন্দিরগুলিতে জ্বলছে।
আখমেনিড সাম্রাজ্য এবং সাইরাস দ্য গ্রেট
ইরানের প্রথম বড় সাম্রাজ্য ছিল মিডিয়ান সাম্রাজ্য (৬৭৮-৫৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), কিন্তু এটিকে শিখরে পৌঁছে দেন সাইরাস দ্য গ্রেট, যিনি আখমেনিড সাম্রাজ্য (৫৫০-৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন। ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সাইরাস ব্যাবিল (ব্যাবিলনিয়া) জয় করেন। এই জয়ের পর তৈরি ‘সাইরাস সিলিন্ডার’ জাতিসংঘ দ্বারা মানবাধিকারের প্রথম ঘোষণা হিসাবে বিবেচিত হয়। এই মাটির সিলিন্ডারে আক্কাদিয়ান ভাষায় লেখা আছে যে সাইরাস দাসদের মুক্ত করেছিলেন, ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, জাতিগত সমতাকে উৎসাহিত করেছিলেন এবং বাস্তুচ্যুত সম্প্রদায়গুলিকে তাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।
ফিরদৌসীর শাহনামা
৯৭৭-১০১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা ফিরদৌসীর ‘শাহনামা’ ফার্সি জাতীয় মহাকাব্য, যাতে ৫০,০০০ শ্লোক রয়েছে। এটি সৃষ্টি থেকে ৭ম শতাব্দীর ইসলামিক বিজয় পর্যন্ত পারস্যের পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক রাজাদের (যেমন রুস্তম এবং কাভুস) গল্প বলে। এটি ইসলামিক যুগে ফার্সি ভাষা ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করেছিল, যখন আরবি প্রভাব বাড়ছিল। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম একক লেখক দ্বারা লিখিত মহাকাব্য, যা তার কাব্যিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের জন্য বিখ্যাত। ইরান, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তানের মতো দেশগুলি এটিকে জাতীয় গৌরব বলে মনে করে।
ভারত-ইরান সম্পর্ক
ভারত ও ইরানের সম্পর্ক প্রাচীন। উভয় অঞ্চলে ইন্দো-ইরানি উপজাতি ছিল, যাদের ভাষা (সংস্কৃত এবং আবেস্তান) ইন্দো-ইউরোপীয় মূলের। সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতা এবং মেসোপটেমিয়ার মধ্যে বাণিজ্য ছিল, এবং হরপ্পার সীল ইরানে পাওয়া গেছে। ৬ষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আখমেনিড সাম্রাজ্য উত্তর-পশ্চিম ভারত (গান্ধার, পাঞ্জাব, সিন্ধ) দখল করে।
মধ্যযুগে, দিল্লি সালতানাত এবং মুঘল সাম্রাজ্যে ফার্সি ভাষা ও সংস্কৃতির গভীর প্রভাব ছিল। ফার্সি মুঘল দরবারের সরকারি ভাষা ছিল, এবং আমির খসরুর মতো কবিরা হিন্দুস্তানি সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। ইরানি স্থাপত্য ফতেহপুর সিক্রি, তাজমহল এবং লাল কেল্লার মতো স্মৃতিস্তম্ভগুলিকে প্রভাবিত করেছিল, যেখানে গম্বুজ, খিলান এবং শিলালিপিতে ফার্সি শৈলী দেখা যায়।
ইসলামের উত্থান এবং ইরান
৭ম শতাব্দীতে আরবরা শেষ দেশীয় রাজবংশ সাসানি সাম্রাজ্য আক্রমণ করে, যার ফলে তার পতন ঘটে। ধীরে ধীরে এই অঞ্চল ইসলামের প্রভাবে আসে। ১৬শ শতাব্দীতে সফভিদ রাজবংশের শাহ ইসমাইল ১৫০১ সালে শিয়া ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন, যাতে সুন্নি অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা পরিচয় তৈরি করা যায়। ১৭শ শতাব্দীর মধ্যে ইরান শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
হুমায়ুন এবং ইরান
১৫৪০ সালে শের শাহ সুরির কাছে পরাজিত হওয়ার পর মুঘল সম্রাট হুমায়ুন ১৫৪৪ সালে ইরানের শাহ তাহমাস্পের কাছে সাহায্যের জন্য যান। শাহ শর্ত দেন যে হুমায়ুন শিয়া ইসলাম গ্রহণ করুন। হুমায়ুন রাজনৈতিক কারণে এটি স্বীকার করেন, এবং শাহের সাহায্যে ১৫৪৫ সালে কান্দাহার এবং কাবুল পুনরুদ্ধার করেন। ১৫৫৫ সালে তিনি আবার দিল্লি দখল করেন। এই রূপান্তর রাজনৈতিকই ছিল। পরবর্তীতে মুঘল চিত্রশিল্প, স্থাপত্য ইত্যাদির উপর ইরানি শৈলীর প্রভাব স্পষ্টভাবে পড়ে। ফার্সি মুঘলদের দরবারি ভাষা ছিল, যারা নিজেরা তুর্কি ভাষায় কথা বলতেন। ফার্সি এবং স্থানীয় উপভাষার মিশ্রণ থেকে ভারতে উর্দু-র মতো ভাষার জন্ম হয়।