বি-২ বোম্বার এবং জিবিইউ-৫৭: আমেরিকা কি এই অস্ত্র দিয়েই ইরানের ওপর হামলা চালিয়েছে?

বি-২ বোম্বার এবং জিবিইউ-৫৭: আমেরিকা কি এই অস্ত্র দিয়েই ইরানের ওপর হামলা চালিয়েছে?

ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন যে, ফোর্দোর ওপর ‘সমস্ত বোমা’ ফেলা হয়েছে এবং সমস্ত বিমান নিরাপদে আমেরিকায় ফিরে যাচ্ছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে, আমেরিকা ইরানের তিনটি পারমাণবিক ঘাঁটি – ফোর্দো (Fordow), নাতাঞ্জ (Natanz) এবং ইস্ফাহান (Isfahan)-এর ওপর তাদের হামলা সম্পন্ন করেছে।

তবে, ইরান দাবি করেছে যে, তারা পারমাণবিক ঘাঁটিগুলো ‘আগেই খালি করে নিয়েছিল’।

ট্রাম্প যে হামলার কথা বলেছেন, তাতে একটি অস্ত্র নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে, সেটি হলো ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনেট্রেটর (Massive Ordnance Penetrator – MOP)। এটিই সেই অস্ত্র হতে পারে যা মার্কিন হামলায় ব্যবহার করা হয়েছে।

এর আনুষ্ঠানিক নাম জিবিইউ-৫৭ (GBU-57)। এর মানে হলো গাইডেড বোম্ব ইউনিট (Guided Bomb Unit) এবং ৫৭ হলো এর ডিজাইন নম্বর।

শুধুমাত্র আমেরিকাই কার্যকরভাবে জিবিইউ-৫৭ ব্যবহার করতে পারে এবং এটি মিসৌরিতে অবস্থিত হোয়াইটম্যান এয়ার ফোর্স বেস (Whiteman Air Force Base) থেকে উড়ে যাওয়া বি-২ স্পিরিট স্টিলথ বোম্বার (B-2 Spirit Stealth Bomber) দ্বারা নিক্ষেপ করা হয়।

রয়টার্স সংবাদ সংস্থা অনুযায়ী, একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন যে, ইরানের ওপর মার্কিন হামলায় বি-২ বোম্বার জড়িত ছিল।

এর আগে এমন খবর সামনে এসেছিল যে, আমেরিকা মার্কিন বি-২ স্টিলথ বোম্বারগুলিকে গুয়াম দ্বীপে (Guam Island) পাঠিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এরপর মনে করা হচ্ছিল যে, আমেরিকা ইরানের ওপর হামলায় এটি ব্যবহার করতে পারে।

জিবিইউ-৫৭ বোমা কতটা বিপজ্জনক?
সহজ কথায় এর মোতায়েন এভাবে হয়: একটি লক্ষ্যবস্তু নির্বাচন করা হয়, বোমা নিক্ষেপকারী বিমানের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণকারী সিস্টেমে লক্ষ্যবস্তুটি প্রবেশ করানো হয় এবং তারপর এই তথ্য বোমাতে স্থানান্তরিত করা হয়।

সঠিক দিকনির্দেশনা স্যাটেলাইট নেভিগেশন দ্বারা হয়। ভারী বোমাটি সাধারণত ৫০ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে নিক্ষেপ করা হয়, যা এটিকে প্রচুর গতিশক্তি (Kinetic Energy) দেয়। অর্থাৎ, গতি থেকে উৎপন্ন শক্তি যা বোমাটিকে মাটির গভীরে প্রবেশ করার ক্ষমতা দেয়।

বোমার বাইরের অংশ বিশেষভাবে মজবুত করে তৈরি করা হয় যাতে আঘাত লাগার পরও এর কাঠামো অক্ষত থাকে।

এর পেছনের অংশে লাগানো ডিলে ফিউজিং সিস্টেম (Delay Fuzing System) নিশ্চিত করে যে, ৫,৩০০ পাউন্ড বিস্ফোরক সঠিক গভীরতায় গিয়ে ফাটবে। প্রায়শই একাধিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়, প্রথম বোমাটি পথ তৈরি করার জন্য এবং দ্বিতীয় বা আরও বোমাগুলি যেকোনো ঘাঁটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করার জন্য। এই সবগুলিকে একই বিন্দুতে নিক্ষেপ করা হয়।

পারমাণবিক অস্ত্র বাদ দিলে, জিবিইউ-৫৭ বোমা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা বলা হয়। এই বোমা শুধুমাত্র আমেরিকার কাছেই আছে।

সঠিক নিশানায় আঘাত হানতে সক্ষম প্রায় ১৩ হাজার ৬০০ কিলোগ্রাম ওজনের এই অস্ত্র সম্ভবত ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক ঘাঁটি ফোর্দো পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্র একটি পাহাড়ের ভিতরে অবস্থিত।

মার্কিন সরকারের মতে, জিবিইউ-৫৭ একটি ‘বিপজ্জনক ভেদক অস্ত্র’, যা গভীর গভীরে চাপা এবং মজবুত বাঙ্কার সহ সুরঙ্গগুলিতে আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে।

ছয় মিটার লম্বা এই অস্ত্রটি বিস্ফোরণের আগে পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬১ মিটার নিচে প্রবেশ করতে সক্ষম বলে মনে করা হয়। এর মাধ্যমে একের পর এক একাধিক বোমা নিক্ষেপ করা যেতে পারে, যার ফলে প্রতিটি বিস্ফোরণের সাথে বোমা আরও গভীরে খনন করতে পারে।

এটি বোয়িং কো ম্পা নি (Boeing Company) তৈরি করেছে এবং এমওপি (MOP) যুদ্ধক্ষেত্রে কখনো ব্যবহার করা হয়নি। আমেরিকার নিউ মেক্সিকো প্রদেশের হোয়াইট স্যান্ডস মিসাইল রেঞ্জে (White Sands Missile Range) এই অস্ত্রের পরীক্ষা করা হয়েছে।

এটি ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স এয়ার ব্লাস্ট (Massive Ordnance Air Blast – MOAB) এর চেয়েও বেশি শক্তিশালী অস্ত্র। এমওএবি ৯ হাজার ৮০০ কিলোগ্রাম ওজনের অস্ত্র, যাকে “মাদার অফ অল বম্বস” (Mother of All Bombs) নামেও পরিচিত।

এটি ২০১৭ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল।

ট্রাম্প হামলায় কী বলেছেন?
ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যাল (Truth Social)-এ লিখেছেন, “আমরা ফোর্দো, নাতাঞ্জ এবং ইস্ফাহান সহ ইরানের তিনটি পারমাণবিক ঘাঁটিতে সফলভাবে হামলা চালিয়েছি। সমস্ত বিমান এখন ইরানের আকাশসীমার বাইরে।”

ট্রাম্প আরও লিখেছেন যে, ফোর্দোর ওপর ‘সমস্ত বোমা’ ফেলা হয়েছে এবং সমস্ত বিমান নিরাপদে আমেরিকায় ফিরে যাচ্ছে।

পাশাপাশি ট্রাম্প লিখেছেন যে, ‘আমাদের মহান আমেরিকান যোদ্ধাদের অভিনন্দন। বিশ্বে এমন কোনো সেনাবাহিনী নেই যারা এটি করতে পারত। এখন শান্তির সময়।’

রয়টার্স সংবাদ সংস্থা অনুযায়ী, ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচারক কান থেকে একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেছেন যে, ইরানের পারমাণবিক ঘাঁটিতে হামলায় ইসরায়েল আমেরিকার সাথে ‘সম্পূর্ণ সমন্বয়’ বজায় রেখেছে।

রয়টার্স সংবাদ সংস্থা অনুযায়ী, মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন যে, ইরানের ওপর মার্কিন হামলায় বি-২ বোম্বার জড়িত ছিল।

ইরান কী বলেছে?
ইরানের সরকারি টিভি চ্যানেলের ডেপুটি পলিটিক্যাল ডিরেক্টর হাসান আবেদিনী সরকারি টিভি চ্যানেলে দাবি করেছেন যে, ইরান পারমাণবিক ঘাঁটিগুলো ‘আগেই খালি করে নিয়েছিল’।

তিনি এও বলেছেন যে, ট্রাম্প যা বলছেন, তা যদি সত্যিও হয়, তবে ইরানের ‘কোনো বড় বিস্ফোরণে কোনো ক্ষতি হয়নি, কারণ পদার্থগুলি আগেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।’

তাসনিম সংবাদ সংস্থা অনুযায়ী, কম প্রদেশের সংকট ব্যবস্থাপনার মুখপাত্র মোরতাজা হায়দারি বলেছেন যে, ‘ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রের একটি অংশ বিমান হামলার শিকার হয়েছে।’

আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই প্রকাশ্যে ইসরায়েলের অস্তিত্ব মুছে ফেলার কথা বলে আসছেন।

ইরান এখন কী করবে?
ইসরায়েলের তেল আবিবে অবস্থিত বিবিসি সংবাদদাতা মার্ক লোভেন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *