‘ম্যাজিক মাশরুম’-এর শুধু এক ডোজ পাঁচ বছর পর্যন্ত দেবে হতাশা থেকে মুক্তি, ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষণায় গবেষকদের বড় দাবি

‘ম্যাজিক মাশরুম’-এর শুধু এক ডোজ পাঁচ বছর পর্যন্ত দেবে হতাশা থেকে মুক্তি, ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষণায় গবেষকদের বড় দাবি

ক্যান্সারের মতো গুরুতর রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য একটি নতুন চিকিৎসাগত আবিষ্কার আশার নতুন আলো নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে যে, ‘ম্যাজিক মাশরুম’ (Magic Mushrooms)-এ পাওয়া সক্রিয় যৌগ সাইলোসায়বিন (Psilocybin), হতাশা এবং উদ্বেগ (Anxiety) থেকে মুক্তি দিতে বিপ্লবী ভূমিকা পালন করতে পারে – এবং তাও মাত্র একটি ডোজে।

এই গবেষণায় দেখা গেছে যে, যখন সাইলোসায়বিন থেরাপির সাথে দেওয়া হয়, তখন এটি রোগীদের কেবল তাৎক্ষণিক মানসিক স্বস্তিই দেয়নি, বরং এর প্রভাব দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বজায় ছিল। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, এই চিকিৎসা ভবিষ্যতে ক্যান্সার রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসায় একটি নতুন মাইলফলক হতে পারে।

কোন জার্নালে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে?
এই গবেষণাটি আমেরিকার স্বনামধন্য আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি (American Cancer Society)-এর পিয়ার-রিভিউড পত্রিকা ‘ক্যান্সার’ (Cancer)-এ প্রকাশিত হয়েছে, যা ওয়াইলি অনলাইন (Wiley Online) দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকদের মতে, ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগের সাথে লড়াই করা মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ সাধারণ সমস্যা, যার চিকিৎসা প্রচলিত ওষুধ এবং মনোচিকিৎসাগত পদ্ধতির মাধ্যমে প্রায়শই আসাম্পূর্ণ থেকে যায়।

গবেষণার প্রধান বিষয়গুলো
এই গবেষণাটি ফেজ-২ ট্রায়াল (Phase-2 Trial) হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে ২৮ জন ক্যান্সার রোগীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যারা গুরুতর বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন।

গবেষণার প্রক্রিয়াটি ছিল নিম্নরূপ:

রোগীদের ২৫ মিলিগ্রাম সাইলোসায়বিন-এর মাত্র একটি ডোজ দেওয়া হয়েছিল।

এই ওষুধ দেওয়ার আগে, চলাকালীন এবং পরে তাদের প্রশিক্ষিত মনোবিজ্ঞানীদের দ্বারা থেরাপি দেওয়া হয়েছিল।

দুই বছর পর যখন এই রোগীদের ফলোআপ (follow-up) করা হয়, তখন অবাক করা ফলাফল সামনে আসে।

প্রভাবশালী ফলাফল
১৫ জন রোগীর (৫৩.৬%) বিষণ্ণতায় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস দেখা গেছে।

১৪ জন রোগীর (৫০%) বিষণ্ণতা কমার সাথে সাথে লক্ষণগুলোর সম্পূর্ণ অবসান (Remission) ঘটেছে।

১২ জন রোগীর (৪২.৯%) উদ্বেগে (Anxiety) দীর্ঘমেয়াদী স্বস্তি দেখা গেছে।

এই ফলাফলগুলি কেবল প্রভাবশালীই নয়, এটি দেখায় যে সাইলোসায়বিন-এর মতো সাইকেডেলিক পদার্থ একবার ব্যবহার করলেও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রধান গবেষকরা কী বলছেন?
এই গবেষণার প্রধান লেখক ড. মনীশ আগরওয়াল (Dr. Manish Agarwal) (সানস্টোন থেরাপিজ) বলেছেন:

“বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ক্যান্সার রোগীদের একবার সাইলোসায়বিন এবং সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট (Psychological Support) দেওয়ার ফলে দুই বছর পর্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। এখন আমরা এই গবেষণা আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, যাতে দেখা যায় যে এই প্রক্রিয়াটি পুনরাবৃত্তি করলে অর্ধেকেরও বেশি রোগী সম্পূর্ণ স্বস্তি পেতে পারে কিনা।”

তিনি এও বলেছেন যে, যদি র‍্যান্ডমাইজড এবং ডাবল-ব্লাইন্ড ট্রায়ালস (Randomized and Double-Blind Trials)-এও একই ফলাফল দেখা যায়, তবে এই চিকিৎসা পদ্ধতি ক্যান্সার রোগীদের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড অফ কেয়ার (Standard of Care) হতে পারে।

পরবর্তী পরিকল্পনা কী?
গবেষকরা এই দিকে এগিয়ে গিয়ে এখন বৃহৎ সংখ্যক রোগী, একটির বেশি ডোজ, এবং ডাবল-ব্লাইন্ড কন্ট্রোলড ট্রায়াল (Double-Blind Controlled Trial) এর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।

এর উদ্দেশ্য হলো এটি নিশ্চিত করা:

এই চিকিৎসা কি সব ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে কাজ করে?

দুটি বা তার বেশি ডোজে কি আরও বেশি সংখ্যক রোগী স্বস্তি পেতে পারে?

এই চিকিৎসা কি নিরাপদ এবং দীর্ঘমেয়াদী হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে?

সাইকেডেলিক চিকিৎসার ভবিষ্যৎ
এই গবেষণাটি সেই সমস্ত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করেছে যা মনে করত যে মানসিক রোগের চিকিৎসায় কেবল নিয়মিত ওষুধই কার্যকর হতে পারে। এখন সাইকেডেলিক পদার্থ (যেমন সাইলোসায়বিন, এলএসডি, ইত্যাদি) থেরাপির সাথে মিশিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য ব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়ছে।

এই চিকিৎসা সেই সমস্ত রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হতে পারে:

যারা প্রচলিত অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট (Antidepressant) থেকে উপকৃত হতে পারছেন না।

যারা টার্মিনাল বা ক্রনিক রোগের কারণে মানসিক চাপে আছেন।

যাদের দ্রুত কিন্তু নিরাপদ স্বস্তির প্রয়োজন।

সাইলোসায়বিন কী?
সাইলোসায়বিন একটি প্রাকৃতিক যৌগ যা বন্য বা চাষ করা কিছু প্রজাতির মাশরুমে পাওয়া যায়। এটি সাধারণত ‘ম্যাজিক মাশরুম’ নামে পরিচিত। এটি মস্তিষ্কের সেরোটোনিন রিসেপ্টরকে (serotonin receptors) প্রভাবিত করে এবং ব্যক্তির চিন্তা, অনুভব এবং বোঝার ক্ষমতাকে সাময়িকভাবে পরিবর্তন করে। নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে এখন এটি চিকিৎসাগত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে, এই গবেষণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের দিকে ইঙ্গিত করে – যেখানে একবারের সাইলোসায়বিন ডোজ ক্যান্সার রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে বছরের পর বছর ধরে স্বস্তি দিতে পারে। যদি ভবিষ্যতের ট্রায়ালগুলোতেও একই ফলাফল পাওয়া যায়, তাহলে এটি মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার জগতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রমাণ হতে পারে। ভারত-এর মতো দেশগুলোতে যেখানে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থান সীমিত, সেখানে এই ধরনের চিকিৎসা একটি নতুন আশা হতে পারে – যদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যবহারের জন্য সঠিক আইনি এবং চিকিৎসা অনুমোদন পাওয়া যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *