ঐতিহ্যবাহী ঔষধের জন্য প্রতি বছর ৬০ লাখ গাধা মারছে চিন! ইজিয়াও শিল্পের ভয়ংকর বাস্তবতা

চিনে ঐতিহ্যবাহী ওষুধ ‘ইজিয়াও’ (Ejiao) তৈরির জন্য প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ গাধা মারা হচ্ছে। এটি কেবল একটি প্রাণীর জীবনের অবসান নয়, বরং একটি বিশাল সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা তৈরি করছে। ইজিয়াও হলো একটি ঐতিহ্যবাহী চিনা ওষুধ, যা গাধার চামড়া থেকে বের করা কোলাজেন দিয়ে তৈরি হয়। এটি স্বাস্থ্যবর্ধক টনিক হিসেবে বিবেচিত হয় এবং ত্বক, রক্ত সঞ্চালন ও শক্তি বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং ঐতিহ্যবাহী ঔষধের প্রতি ক্রমবর্ধমান বিশ্বাস ইজিয়াওয়ের চাহিদা আকাশচুম্বী করে তুলেছে। অনুমান করা হচ্ছে যে, ২০২৭ সালের মধ্যে ৬৮ লাখ গাধার চামড়ার প্রয়োজন হবে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, চিনে গাধার সংখ্যা ১৯৯২ সালে প্রায় ১.১ কোটি ছিল, যা ২০২৩ সালের মধ্যে কমে মাত্র ১৫ লাখে দাঁড়িয়েছে। এই চাহিদা মেটাতে চিন এখন আফ্রিকা, পাকিস্তান এবং ল্যাটিন আমেরিকার মতো দেশগুলির দিকে ঝুঁকছে। আফ্রিকার দেশগুলিতে, যেখানে গাধা কৃষক এবং গ্রামবাসীদের জন্য পরিবহন ও কৃষিকাজের প্রধান উৎস, সেখানে এই প্রাণীগুলির চুরি এবং অবৈধভাবে হত্যার ঘটনা দ্রুত বেড়েছে। চোরেরা রাতের অন্ধকারে গাধা চুরি করে নিয়ে যায় এবং অমানবিক উপায়ে তাদের হত্যা করে। এতে পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা তো বাড়ছেই, সেইসঙ্গে পশুসম্পদের উপর নির্ভরশীল মানুষের জীবিকাও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
ইজিয়াও শিল্পের বৈশ্বিক প্রভাব ও সমাধান
চিন এই শিল্পের প্রধান কেন্দ্র এবং ইজিয়াওয়ের বৃহত্তম ভোক্তা হলেও, অন্যান্য দেশও এই ব্যবসায় জড়িত। যেমন- নাইজেরিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়ার মতো আফ্রিকান দেশগুলিতে গাধার চামড়া রফতানি করা হয়। এর পাশাপাশি, পাকিস্তান এবং ব্রাজিলের মতো দেশগুলিতেও গাধার চামড়ার ব্যবসা শুরু হয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় যে, যে দেশগুলিতে গাধা হত্যা নিষিদ্ধ, সেখানেও অবৈধ পাচার ও দুর্নীতির কারণে এই ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছে।
এরই মধ্যে, ব্রিটেনের দাতব্য সংস্থা ‘দ্য ডঙ্কি স্যাংচুয়ারি’ জানিয়েছে যে, “ইজিয়াও শিল্প বিশ্বব্যাপী গাধার চামড়ার ব্যবসা চালাচ্ছে, যার বেশিরভাগই অবৈধ।” সংস্থাটির মতে, গত বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫৯ লাখ গাধা মারা হয়েছে। গাধার ক্রমবর্ধমান দামের কারণে তারা এখন অপরাধীদের নিশানায় পরিণত হয়েছে। দাতব্য সংস্থাটি বলেছে, “ব্যবসায়ীরা দুর্বল মানুষের সুযোগ নিচ্ছে এবং গাধার মালিকদের তাদের পশু বিক্রি করার জন্য চাপ দিতে বড় এবং সুসংগঠিত এজেন্ট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে।” সংস্থাটি আরও জানিয়েছে যে, গাধা প্রায়শই অমানবিক এবং অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে মারা যায় এবং বিপুল সংখ্যক গাধা জবাইখানায় পৌঁছানোর আগেই মারা যায়। বহু দেশে দরিদ্র মহিলা ও শিশুরা এর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, কারণ তারা জমিতে হাল চালাতে এবং বাজারে জিনিসপত্র নিয়ে যেতে গাধার উপর নির্ভরশীল। সংস্থাটি আরও বলেছে যে, অপরিশোধিত চামড়ার পরিবহন এবং গাধার মৃতদেহের অনুপযুক্ত নিষ্পত্তি সংক্রামক রোগ ছড়ানো এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি করছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই পরিস্থিতিতে কী করা যেতে পারে? এর উত্তরে গাধার সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে আইন তৈরি করা এবং কঠোরভাবে তা প্রয়োগ করা উচিত। এছাড়াও, গাধার গুরুত্ব এবং অবৈধ ব্যবসার খারাপ প্রভাব সম্পর্কে গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলিকে সচেতন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এমন বিকল্প তৈরি করা উচিত যা গাধার চামড়া ছাড়াই ইজিয়াও-এর মতো পণ্য উৎপাদন সম্ভব করে তোলে। গাধার ব্যাপক হত্যা কেবল একটি প্রজাতির জন্যই হুমকি নয়, বরং এটি একটি সম্পূর্ণ সামাজিক এবং পরিবেশগত সংকটের ইঙ্গিতও বটে। চিনে ইজিয়াওয়ের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিবেচনা করে এই বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গুরুতর আলোচনা এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পশু কল্যাণ, ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান এবং আধুনিক নৈতিকতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা আজকের একটি বড় প্রয়োজন।