ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পর কেন ইরানে শুরু হলো গণগ্রেফতার ও ফাঁসির হিড়িক?

ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পর কেন ইরানে শুরু হলো গণগ্রেফতার ও ফাঁসির হিড়িক?

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্প্রতি সংঘাতের পর ইরানে গ্রেফতার ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে বহু মানুষকে গ্রেফতার করেছে ইরানি কর্তৃপক্ষ। অনেকের ওপর মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হয়েছে।

ইরানি কর্মকর্তাদের দাবি, ইসরায়েলি গোয়েন্দারা ইরানের গোয়েন্দা বিভাগে অনুপ্রবেশ করেছে।

কর্মকর্তাদের সন্দেহ, ইরানের শীর্ষ নেতাদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে হত্যার ছক কষতে ইরানের গোয়েন্দা বিভাগ থেকেই ইসরায়েলকে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছিল।

সম্প্রতি সংঘাতে ইসরায়েল ইরানের সামরিক বাহিনীর অংশ ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (IRGC)-এর বহু সিনিয়র কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীর ওপর হামলা চালায়।

এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইরান ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-কে দায়ী করেছে।

এমন নিখুঁতভাবে হত্যাকাণ্ড কার্যকর করায় ইরানি কর্মকর্তাদের পায়ের তলার মাটি সরে গেছে।

গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ফাঁসি

দেশের সুরক্ষায় হুমকি তৈরি করার কথা বলে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে কাজ করার সন্দেহে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তিকে টার্গেট করছে ইরানি কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু অনেকে আশঙ্কা করছেন, এসব কিছু করা হচ্ছে সরকার-বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করতে এবং মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে।

ইসরায়েলের সঙ্গে যখন সংঘাত চলছিল, সেই ১২ দিনের মধ্যে ইরানি কর্তৃপক্ষ গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তিনজনকে ফাঁসি দিয়েছে।

যুদ্ধবিরতির একদিন পর আরও তিনজনকে একই অভিযোগে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।

সেই থেকে কর্তৃপক্ষ দেশজুড়ে শত শত সন্দেহভাজনকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করার কথা ঘোষণা করেছে।

গ্রেফতারকৃতদের কথিত স্বীকারোক্তিও সরকারি সংবাদ সংস্থা প্রকাশ করেছে।

এ কারণে মানবাধিকার সংস্থা ও কর্মীরা এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ইরানে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় ও ভুলভাবে মামলা চালানোর দীর্ঘদিনের প্রথা রয়েছে। অনেকের আশঙ্কা, ভবিষ্যতেও এমনভাবে আরও অনেককে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে।

ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের দাবি, তারা সিআইএ, মোসাদ ও এমআই৬-এর মতো ‘পশ্চিমা ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর’ নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

IRGC-র সঙ্গে যুক্ত ফার্স সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে যে, ১৩ জুন ইসরায়েলের হামলা শুরু হওয়ার পর ‘ইরানে ইসরায়েলি গুপ্তচরদের নেটওয়ার্ক অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে।’

ফার্স জানিয়েছে, ১২ দিনের মধ্যে ইরানের গোয়েন্দা বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনী ‘এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ৭০০-এরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার করেছে।’

ইরানি নাগরিকরা বিবিসি ফার্সিকে বলেছেন, তারা ইরানের গোয়েন্দা মন্ত্রণালয় থেকে সতর্কতামূলক টেক্সট মেসেজ পেয়েছেন।

এতে বলা হয়েছে, তাদের ফোন নম্বর ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত সোশ্যাল মিডিয়া পেজে দেখা যাচ্ছে। তাদের সেই পেজগুলো ডিলিট করতে বলা হচ্ছে। তা না করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

সাংবাদিক ও তাদের পরিবারও সন্দেহের তালিকায়

ইরানি সরকার বিদেশে ফার্সি ভাষার সংবাদ সংস্থাগুলোতে কর্মরত সাংবাদিকদের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিবিসি ফার্সি, লন্ডন-ভিত্তিক ইরান ইন্টারন্যাশনাল এবং মনোটো টিভি।

ইরান ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, IRGC তাদের এক টিভি অ্যাঙ্করের বাবা, মা ও ভাইকে গ্রেফতার করেছে।

এর উদ্দেশ্য ছিল এই অ্যাঙ্কর যেন ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের বিষয়ে রিপোর্ট করা বন্ধ করে দেন। অ্যাঙ্করের বাবা (নিরাপত্তা সংস্থার নির্দেশে) ফোন করে পদত্যাগ করার অনুরোধ করেন।

তিনি এও বলেন যে, তা না করলে খারাপ পরিণতি হবে।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে বিবিসি ফার্সির সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা যে ধরনের হুমকি পাচ্ছেন, তা আরও গুরুতর আকার ধারণ করেছে।

এই হুমকি-ধমকির শিকার সাংবাদিকরা জানান, ইরানি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং বলছেন যে, যুদ্ধের পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের বন্দী করা হতে পারে।

তারা সাংবাদিকদের ‘মোহেরিব’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন। আল্লাহ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধকারীদের ‘মোহেরিব’ বলা হয়।

ইরানি আইন অনুযায়ী, এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

মনোটো টিভিও এমন ঘটনার কথা জানিয়েছে। তাদের কর্মীদের পরিবারকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং চ্যানেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলা হয়েছে।

তাদের আত্মীয়দের বলা হচ্ছে যে, তাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হতে পারে।

এই দুটি অভিযোগেই ইরানি আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।

বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনের চেষ্টা

বিশ্লেষকদের মতে, এগুলো বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনের চেষ্টা এবং নির্বাসিত সংবাদকর্মীদের মধ্যে ভয় তৈরি করার একটি বড় পরিকল্পনার অংশ।

নিরাপত্তা বাহিনী ডজনখানেক কর্মী, লেখক ও শিল্পীকেও গ্রেফতার করেছে। অনেককে কোনো অভিযোগ ছাড়াই গ্রেফতার করা হয়েছে।

কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ‘নারী, জীবন ও স্বাধীনতা’ নামক এক আন্দোলন চলাকালীন নিহতদের পরিবারকেও টার্গেট করা হচ্ছে।

যুদ্ধের সময় ইরানি সরকার ইন্টারনেট ব্যবহারে অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। যুদ্ধবিরতির পরও সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়নি।

এ ধরনের সংকটের সময়, বিশেষ করে সরকার-বিরোধী দেশব্যাপী আন্দোলন হলে, সরকার কর্তৃক ইন্টারনেটে বিধিনিষেধ আরোপ করা এখন সাধারণ হয়ে উঠেছে।

এছাড়াও ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রাম, এক্স এবং ইউটিউব-এর মতো বেশিরভাগ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের পাশাপাশি বিবিসি ফার্সির মতো নিউজ ওয়েবসাইটগুলোও ইরানে নিষিদ্ধ।

ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক অর্থাৎ ভিপিএন প্রক্সি সার্ভিসের মাধ্যমেই কেবল এই ওয়েবসাইটগুলো দেখা যায়।

সম্প্রতি সংঘটিত সংঘাতের তুলনা মানবাধিকার কর্মী ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ১৯৮০-এর দশকের ঘটনার সঙ্গে করছেন। তাদের মতে, সে সময়ও ইরানি কর্মকর্তারা ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্দয়ভাবে পিষে ফেলেছিল।

অনেকে আশঙ্কা করছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের কারণে দেশ যখন দুর্বল অবস্থায়, তখন কর্তৃপক্ষ আবারও দমন-পীড়নের নীতি গ্রহণ করতে পারে।

এতে গণগ্রেফতার, মৃত্যুদণ্ড ও তীব্র দমন-পীড়নের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।

বিরোধীরা ১৯৮৮ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। কিছু মানবাধিকার সংস্থার মতে, সে সময় হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দীকে (যাদের অনেকেই আগেই সাজা ভোগ করছিলেন) ‘ডেথ কমিশন’-এর কথিত সংক্ষিপ্ত ও গোপন শুনানির ভিত্তিতে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।

বেশিরভাগ ভুক্তভোগীকে নামহীন কবরে দাফন করা হয়েছিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *