‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর বদলে যাচ্ছে ভারতের আকাশসীমা: ২৪x৭ নজরদারির জন্য ৫২টি স্যাটেলাইট!

‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার, সিগন্যাল জ্যামিং এবং রাডার প্রযুক্তির ভূমিকা বিশ্ব দেখেছিল। ভারত ২২ মিনিট ধরে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলির সম্পূর্ণ সিগন্যাল জ্যাম করে দিয়েছিল। আর এই ২২ মিনিটেই ভারতের বিমান বাহিনী পাকিস্তানের উপর ভয়াবহ আক্রমণ চালায়। ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ারের এই যুদ্ধ মহাকাশে ভারতের সামরিক উপগ্রহগুলির কারণে সম্ভব হয়েছিল।
এই স্যাটেলাইটগুলোই পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর (PoK)-এ অবস্থিত জয়শ-ই-মুহাম্মদ, লস্কর-ই-তৈয়বা এবং হিজবুল মুজাহিদিনের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির ঘাঁটির সঠিক অবস্থান জানাতে পারছিল। এই গোয়েন্দা তথ্যের সাহায্যেই ভারত পাকিস্তান ও PoK-এর বাহাওয়ালপুর, মুজাফফরাবাদ, কোটলি এবং সিয়ালকোটের মতো সন্ত্রাসী শিবিরগুলিতে সুনির্দিষ্ট হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছিল।
এবার ভারত আধুনিক যুদ্ধের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটিকে আরও শক্তিশালী করতে চলেছে।
২৪x৭ নজরদারির জন্য ৫২টি নতুন স্যাটেলাইট
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর ভারত প্রতিকূল অঞ্চলগুলির ক্রমাগত নজরদারি বাড়ানোর জন্য ৫২টি নজরদারি উপগ্রহের উৎক্ষেপণ দ্রুত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে ভারত দক্ষিণ এশিয়া সহ সারা বিশ্বের স্যাটেলাইট ছবি পেতে সক্ষম হবে। প্রয়োজনে ভারত সামরিক উদ্দেশ্যেও এগুলি ব্যবহার করতে পারবে।
ভারত মহাকাশ-ভিত্তিক নজরদারি বাড়ানোর জন্য গত বছর অক্টোবর মাসে ২৬,৯৬৮ কোটি টাকার একটি বিশাল বাজেট পাস করেছে। এই স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কগুলির স্থাপন এই প্রকল্পেরই একটি অংশ।
এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের অধীনে ইসরো ২১টি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে, যেখানে তিনটি বেসরকারি সংস্থা বাকি ৩১টি উপগ্রহ নির্মাণ ও উৎক্ষেপণ করবে। এর উৎক্ষেপণের সময়সীমা আরও কঠোর করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে যে, এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য প্রথম উপগ্রহটি এপ্রিল ২০২৬-এর মধ্যে উৎক্ষেপণ করা হবে এবং পুরো নেটওয়ার্কটি ২০২৯ সালের শেষের আগে কক্ষপথে স্থাপন করা হবে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধান ও লক্ষ্য
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে ইন্টিগ্রেটেড ডিফেন্স স্টাফ (IDS) এই প্রকল্পের তদারকি করছে। ইন্টিগ্রেটেড ডিফেন্স প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভারতের কৌশলগত সুবিধা বাড়ানোর জন্য কাজ করছে।
এই উপগ্রহ উৎক্ষেপণের উদ্দেশ্য হলো চীন, পাকিস্তান এবং ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কভারেজ উন্নত করা, পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা উন্নত করার জন্য পরিষ্কার ছবি সংগ্রহ করা। এই উপগ্রহগুলি শত্রুর কার্যকলাপের উপর নজর রাখার উন্নত ক্ষমতা প্রদান করে স্থলসেনা, নৌসেনা এবং বিমানবাহিনীকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
‘অপারেশন সিঁদুর’ (৭-১০ মে) চলাকালীন ভারত শত্রুর গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য কার্টোস্যাটের মতো দেশীয় উপগ্রহ এবং বাণিজ্যিক বিদেশী উপগ্রহ উভয় ব্যবহার করেছিল। কিন্তু বিদেশী উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ভারতীয় বিমান বাহিনী উচ্চ উচ্চতায় কাজ করতে সক্ষম ছদ্ম উপগ্রহ (High-Altitude Pseudo Satellites) অর্জনের পরিকল্পনা করছে। UAV-এর মতো এই প্ল্যাটফর্মগুলি দীর্ঘ সময়ের জন্য স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে থাকতে পারবে। এই ছদ্ম উপগ্রহগুলি ভারতকে গোয়েন্দা, নজরদারি এবং রেকোনাইস্যান্স মিশনে সহায়তা করবে।
হাই-অল্টিটিউড স্যুডো স্যাটেলাইটস (HAPS) কী?
হাই-অল্টিটিউড স্যুডো স্যাটেলাইটস (HAPS) হলো উচ্চ উচ্চতায় (প্রায় ১৮-২২ কিমি) উড়তে সক্ষম মানববিহীন বিমান যান (UAV), যা উপগ্রহের মতো কাজ করে। এগুলি সৌর শক্তি বা ব্যাটারি দ্বারা চালিত হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে বাতাসে থাকতে পারে। HAPS যোগাযোগ, নজরদারি, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবহৃত হয়। এগুলি প্রচলিত উপগ্রহের তুলনায় কম ব্যয়বহুল এবং আরও নমনীয়, কারণ এগুলিকে সহজেই স্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
স্যাটেলাইট সার্ভিল্যান্স কী?
স্যাটেলাইট সার্ভিল্যান্স এমন একটি প্রযুক্তি যেখানে উপগ্রহ ব্যবহার করে পৃথিবীর পৃষ্ঠে ঘটে যাওয়া কার্যকলাপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হলো স্থান বা লক্ষ্যবস্তুর নজরদারি এবং তথ্য সংগ্রহ। এটি মূলত সামরিক, গোয়েন্দা, পরিবেশগত এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে উপযোগী। স্যাটেলাইটগুলি উচ্চ-রেজোলিউশন ক্যামেরা, রাডার, ইনফ্রারেড সেন্সর এবং অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত থাকে, যা রিয়েল-টাইমে বা নিয়মিত বিরতিতে ছবি, ভিডিও এবং অন্যান্য ডেটা সংগ্রহ করে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলি এই ডেটা ব্যবহার করে লক্ষ্যবস্তু সনাক্তকরণ, কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ এবং কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবিগুলি শত্রুর অপপ্রচারের মোকাবিলা করতে পারে। ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি ব্যবহার করে পাকিস্তানের সেই দাবিগুলি বাতিল করে দিয়েছিল যে, এই হামলায় তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
স্যাটেলাইট সার্ভিল্যান্স ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদ, রিয়েল-টাইম নজরদারি এবং কৌশলগত সমন্বয়ের মাধ্যমে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করতে অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছে।