ইতিহাস থেকে কি কিছুই শেখা হয়নি? মধ্যপ্রাচ্য আবারও যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে

ইতিহাস থেকে কি কিছুই শেখা হয়নি? মধ্যপ্রাচ্য আবারও যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে

মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে এমন ভয়ঙ্কর বাস্তবতা আর কখনও দেখা যায়নি। ইরানের উপর ইসরায়েলের একতরফা ও আক্রমণাত্মক হামলা বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও বিপজ্জনক করে তুলছে। এর পাশাপাশি, ইরানের পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাঙ্কার বাস্টার বোমা হামলা আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে।

১৩ জুন ২০২৫ থেকে ইসরায়েলি হামলা এবং ইরানের পাল্টা আক্রমণ বা প্রতিরোধের যুদ্ধ নিঃসন্দেহে ইসরায়েল ও আমেরিকার সামরিক নেতাদের বিস্মিত ও হতাশ করেছে। ইরানকে দুর্বল করা, সরকার উৎখাত করার ষড়যন্ত্র এবং পারমাণবিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ সৃষ্টি করার স্বপ্ন ধুলোয় মিশে গেছে।

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকা ও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা সত্যি নাকি নিছকই কৌতুক, তা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে। যুদ্ধবিরতি হোক বা না হোক, মধ্যপ্রাচ্যের ইতিমধ্যেই অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। যদি সব পক্ষ এখন শান্তির পথে না হাঁটে, তাহলে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

বিশ্ব রাজনীতিতে শান্তি ও সংলাপের অভাব
বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সংলাপ-ভিত্তিক সমাধান যতটা প্রয়োজনীয়, ততটাই দুর্লভ হয়ে উঠেছে। পরাশক্তিদের নীতিগত অবস্থান এবং সামরিক পদক্ষেপ আজ আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

জাতিসংঘের সনদ এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অন্তর্নিহিত ন্যূনতম নীতিগুলো – যেমন কোনো স্বাধীন দেশের উপর সরাসরি আক্রমণ না করা পর্যন্ত হামলা না করা এবং তার সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো – উপেক্ষা করা হচ্ছে। ফলস্বরূপ, শান্তির ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কাঠামো ক্রমাগত জটিল হয়ে উঠছে।

মধ্যপ্রাচ্যের পুরনো ক্ষত ও সামরিকীকরণ
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সামরিক সমাধানের প্রবণতা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশটি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কৌশল হিসেবে বারবার সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করেছে এবং একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ এই প্রবণতার একটি প্রধান উদাহরণ ছিল।

যদিও ইসরায়েল কিছু অস্থায়ী কৌশলগত সুবিধা পেয়েছিল, তবে দীর্ঘমেয়াদে এই যুদ্ধের পরিস্থিতি স্থায়ী শান্তি বা নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারেনি। এর পরিবর্তে, দেশটি একটি সামরিক-নির্ভর রাজ্যে পরিণত হয়েছে। ২০২৪ সালে ইসরায়েলের সামরিক ব্যয় ৬৫ শতাংশ বেড়ে ৪৬.৫ বিলিয়ন ডলার হবে, যার মধ্যে শুধুমাত্র ডিসেম্বরে ৫.৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে।

এটি ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে বড় বার্ষিক বৃদ্ধি, যখন এর জিডিপিতে ৮.৮ শতাংশ অংশ ছিল। ২০১৫ সালে এটি ছিল ৫.৪ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি। এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েল বা তার মিত্র দেশগুলোর কেউই শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের দিকে কোনো কার্যকর কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয়নি।

পরিবর্তে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির নীতিই প্রাধান্য পেয়েছে। যদিও শান্তি প্রতিষ্ঠায় আলোচনার গুরুত্ব নিয়ে বারবার আলোচনা হয়েছে, তবে বাস্তবে তা খুব কমই দেখা গেছে। ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে এখনও অনেক বাকি। জাতিসংঘে এই ধরনের প্রস্তাব ভেটোর মাধ্যমে অবরুদ্ধ করা হয়েছে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা।

সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যর্থতা এবং ইরানের বর্তমান পরিস্থিতি
যুদ্ধের মাধ্যমে নিরাপত্তা অর্জনের কৌশল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে সামরিক হস্তক্ষেপ এবং শাসন পতনের মাধ্যমে শান্তি অর্জন করা যায় না। এই দেশগুলিতে রাজনৈতিক শূন্যতা, গৃহযুদ্ধ এবং বাহ্যিক শক্তির উপর নির্ভরশীলতা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য আরও জটিল পরিবেশ তৈরি করেছে। ফলস্বরূপ, এই প্রশ্নটি এখন আগের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক – সামরিক শক্তি কি একটি কার্যকর সমাধান?

ইরানের বর্তমান প্রেক্ষাপটেও একই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হচ্ছে। ইরান বারবার বলেছে যে তার পারমাণবিক কর্মসূচি পারমাণবিক অপ্রসারণ চুক্তি (এনপিটি)-এর সদস্য এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। দেশটি বলেছে যে তারা পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে, ইরানের চারপাশে ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্তেজনা ভবিষ্যতে একটি বড় সংঘাতের কারণ হতে পারে।

পরিবর্তিত বিশ্বশক্তি ভারসাম্য এবং যুদ্ধের পরিণতি
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বিশ্বশক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট। ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলি দ্বারা পরিচালিত সামরিক পদক্ষেপগুলি তাদের মিত্রদের সমর্থনের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে ব্যাপক প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়নি। কিন্তু আজ বিশ্বের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ইউক্রেনের ইস্যুতে রাশিয়ার সাথে মতবিরোধ, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে চীনের একটি প্রধান বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে উত্থান এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ভারতের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব, এখন কোনো একটি রাষ্ট্রের পক্ষে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একতরফা হস্তক্ষেপ করা সহজ নয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন যে যুদ্ধ ক্ষণস্থায়ী সমাধান দিতে পারে। এর দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি হলো প্রজন্মগত সংকট। গাজা উপত্যকায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সংঘাতে এটি স্পষ্ট, যেখানে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহৃত একতরফা সামরিক অভিযান শান্তির পথকে আরও জটিল করে তুলেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *