তালেবানের সঙ্গে ‘ভ্রাতৃত্ব’ এখন মাথাব্যথা! রাশিয়ার সিদ্ধান্তের পর শঙ্কিত পাকিস্তান, স্বীকৃতি প্রদানে পিছিয়ে এল

তালেবানের সঙ্গে ‘ভ্রাতৃত্ব’ এখন মাথাব্যথা! রাশিয়ার সিদ্ধান্তের পর শঙ্কিত পাকিস্তান, স্বীকৃতি প্রদানে পিছিয়ে এল

চার বছর আগে যখন কাবুলে তালেবান নিজেদের পতাকা উড়িয়েছিল, তখন পাকিস্তানে যেন এক উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। ইমরান খানের সরকার একে “দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি” বলে অভিহিত করেছিল এবং পাকিস্তানের রাস্তায় প্রকাশ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছিল। সেখানকার অনেক কট্টরপন্থী নেতা তালেবানকে “ভাই” বলতে শুরু করেছিলেন এবং ইসলামাবাদে এই দাবি জোরালো হয়ে উঠছিল যে, এখন আফগানিস্তানে “বন্ধুত্বের যুগ” শুরু হবে। কিন্তু এখন সেই পাকিস্তানই নীরব… শঙ্কিত এবং বিশ্বের নজর এড়িয়ে ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসছে।

‘ভ্রাতৃত্বের’ দেওয়ালে ফাটল
তালেবানকে প্রথম আলিঙ্গন করার আগ্রহ দেখানো পাকিস্তান, এখন চার বছর পর তালেবানকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে ভয় পাচ্ছে। একদিকে যখন রাশিয়া তালেবান সরকারকে বিশ্বের সামনে “বৈধ” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তখন পাকিস্তান নিজেদের পদক্ষেপ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে যে, “ইসলামাবাদের কোনো তাড়াহুড়ো নেই, আমরা দেশের স্বার্থে ভেবেই কোনো সিদ্ধান্ত নেব।” অর্থাৎ, যে তালেবানকে গতকাল পর্যন্ত ‘ভাই’ বলা হচ্ছিল, আজ তার নাম শুনলেই পাকিস্তানি নেতারা “কূটনৈতিক ঢাল” তুলে ধরছেন।

তালেবানের বিরুদ্ধে টিটিপিকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ, সম্পর্কে তিক্ততা
আসল সমস্যার মূলে রয়েছে অন্য কিছু। তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানের সন্ত্রাসী সংগঠন টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান)-এর অনেক কট্টর জঙ্গিকে আশ্রয় দিয়েছে। এই সেই টিটিপি, যারা পাকিস্তানের ভেতরে পেশোয়ারের স্কুল থেকে শুরু করে কোয়েটার ক্যাম্প পর্যন্ত অসংখ্য হামলা চালিয়েছে। এখন পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা নিজেরাই স্বীকার করছে যে, তালেবান টিটিপির বিরুদ্ধে কোনো ठोस ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এই ইস্যুতে ইসলামাবাদ ও কাবুলের মধ্যে একাধিকবার চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। যেখানে তালেবান বারবার অস্বীকার করে যে তারা কোনো সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দিয়েছে, সেখানেই পাকিস্তান এখন প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের অসন্তোষ দেখাচ্ছে।

শরণার্থীদের নিয়ে বিতর্ক, বিশ্ব দেখছে পাকিস্তানের আসল রূপ
তালেবানের উপর ক্ষুব্ধ পাকিস্তান এখন আরেকটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে – পাকিস্তানে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ আফগান শরণার্থীকে জোর করে দেশ থেকে বের করে দেওয়া শুরু করেছে। এই পদক্ষেপের বিশ্বজুড়ে সমালোচনা হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন থেকে শুরু করে জাতিসংঘ পর্যন্ত পাকিস্তানের এই ‘নির্মম’ নীতির উপর অসন্তুষ্ট। অনেক রিপোর্টে এও উঠে এসেছে যে, পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত আফগানদের তালেবানও গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়, যার ফলে একটি নতুন মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে।

আইএমএফ, আমেরিকা এবং আন্তর্জাতিক চাপও একটি বড় কারণ
তালেবানকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক স্তরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে – এই ভয়ও ইসলামাবাদকে সতর্ক করেছে। পাকিস্তানের অর্থনীতি এই মুহূর্তে আইসিইউতে। আইএমএফ থেকে পাওয়া ত্রাণ প্যাকেজ, আমেরিকার সাহায্য এবং ইউরোপীয় দেশগুলির বিনিয়োগের ওপর পাকিস্তানের অর্থনীতি নির্ভরশীল। এমন পরিস্থিতিতে তালেবানের মতো একটি সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া পাকিস্তানের জন্য অর্থনৈতিক আত্মহত্যার মতো পদক্ষেপ হতে পারে। পাকিস্তানি কর্মকর্তারাও এখন নিচু স্বরে স্বীকার করছেন যে, “আমরা আমাদের কূটনীতি খুব সাবধানে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তালেবানের সমর্থনের চেয়ে আমাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বেশি জরুরি।”

রাশিয়ার সিদ্ধান্ত ইসলামাবাদকে নাড়িয়ে দিয়েছে
রাশিয়া কর্তৃক তালেবানকে দেওয়া স্বীকৃতি পাকিস্তানকে আবারও দ্বিধায় ফেলেছে। রাশিয়া এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাতে তারা আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে নিজেদের শক্তিশালী করতে পারে এবং চিন-পাকিস্তান জুটিকে একটি ভারসাম্য দিতে পারে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, রাশিয়ার এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে ইরান, তুর্কমেনিস্তান বা এমনকি ভারতকেও তালেবানের পক্ষে ঝুঁকে দিতে পারে। পাকিস্তান ভয় পাচ্ছে যে, তারা নিজেদের তৈরি ‘ভাই’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে এবং আফগানিস্তানে তাদের কৌশলগত প্রভাব শেষ হয়ে যেতে পারে।

তাহলে কি পাকিস্তান হার মানবে?
এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত পাকিস্তানের কাছেও নেই। সেখানকার কর্মকর্তারা স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, “যতক্ষণ না তালেবান পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করে, ততক্ষণ আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নেব না।” তবে এটিও একটি তিক্ত বাস্তবতা যে, তালেবান এখন পাকিস্তানের কথা শুনতে রাজি নয়। আফগানিস্তানের নতুন সরকার এখন নিজেদের সম্পূর্ণ স্বাধীন মনে করে এবং তারা পাকিস্তানের ‘ছত্রছায়া’ থেকে বেরিয়ে এসেছে।

শেষ প্রশ্ন বড়ই গুরুতর
যে তালেবানকে পাকিস্তান একসময় লালন-পালন করে বড় করেছে, এখন কি তারাই তার জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে? রাশিয়ার মতো পাকিস্তানও কি শীঘ্রই ‘ব্যবহারিক’ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে তালেবানকে স্বীকৃতি দেবে? নাকি চাপের মুখে আবারও নিজেদের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে? উত্তর আগামী মাসগুলোতে পাওয়া যেতে পারে, তবে আজকের তারিখে এটা নিশ্চিত যে পাকিস্তানের ‘তালেবানি বন্ধুত্ব’ এখন ভাঙনের মুখে… এবং এই ফাটল এত গভীর যে কোনো মিষ্টিভরা উৎসবও এটি পূরণ করতে পারবে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *