দুর্ঘটনা না ষড়যন্ত্র? বিশ্বের সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ হঠাৎ ডুবে গেল-জানুন রহস্য

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল সময়ে জার্মানির একচ্ছত্র আধিপত্য যখন ইউরোপ জুড়ে প্রতিষ্ঠিত, একমাত্র ব্রিটেনই তখন প্রতিরোধের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অ্যাডলফ হিটলার বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটেনকে পরাস্ত করতে হলে তাদের শক্তিশালী নৌবাহিনীকে হারাতেই হবে। এই লক্ষ্যেই জার্মান প্রকৌশলীরা তৈরি করেন বিশ্বের সবচেয়ে বিশাল ও শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ বিসমার্ক। টাইটানিকের প্রায় সমতুল্য দৈর্ঘ্যের এই জাহাজটি প্রস্থে এবং ওজনে ছিল টাইটানিকের চেয়েও বেশি, কারণ এটি ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। বিসমার্কের আর্মার সিস্টেম বা বর্ম ছিল তৎকালীন সব যুদ্ধজাহাজের চেয়ে শক্তিশালী। ১৯৩৬ সালে হামবার্গের ব্লোহাম ও ভস শহরে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৪০ সালের আগস্টে জার্মান নৌবাহিনীতে (Kriegsmarine) এটি যুক্ত হয়। ২৪১.৬ মিটার লম্বা এই যুদ্ধজাহাজের ডিসপ্লেসমেন্ট ছিল ৫০,৩০০ টন, যা আধুনিক ছয়টি ডেস্ট্রয়ারের সমান। ৩০.০১ নট বা ৫৫.৫৮ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিসম্পন্ন বিসমার্কে ১০৩ জন অফিসার সহ ২,০৬৫ জন সেনা থাকতে পারতো। জার্মান চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্কের নামানুসারে এই জাহাজের নামকরণ করা হয়।

বিসমার্কের প্রথম মিশন ছিল আটলান্টিক মহাসাগরে ব্রিটেনের সাহায্যকারী জাহাজগুলোকে আক্রমণ করা। যখন ব্রিটেন খবর পায় যে বিসমার্ক তার প্রথম মিশনে বেরিয়েছে, তখন তারা তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস প্রিন্স অফ ওয়েলস এবং এইচএমএস হুড-কে পাঠায়। এইচএমএস হুড ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী জাহাজ হিসেবে পরিচিত ছিল। উভয় জাহাজের মধ্যে ২৬ কিলোমিটার দূরত্বে শুরু হওয়া এই ভয়াবহ যুদ্ধে, মাত্র নয় মিনিটের মধ্যে অবিশ্বাস্যভাবে এইচএমএস হুড ডুবে যায়। বিসমার্কের শক্তিশালী বর্মের কারণে এইচএমএস হুডের আক্রমণ তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। প্রথম যুদ্ধে বিসমার্কের কিছু ক্ষতি হলেও, তা এমন ছিল না যে এটি ডুবে যায়। এইচএমএস হুডের ডুবে যাওয়ার খবর পুরো ব্রিটিশ নৌবাহিনীকে হতবাক করে দেয়। এরপর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ৬০টি যুদ্ধজাহাজকে নির্দেশ দেন যেকোনো মূল্যে বিসমার্ককে খুঁজে বের করে ডুবিয়ে দিতে। অবশেষে, একটি ব্রিটিশ জাহাজ বিসমার্ককে খুঁজে পায় এবং টর্পেডো হামলার জন্য ১৫ থেকে ২০টি যুদ্ধবিমান পাঠায়। ব্রিটিশ পাইলটরা সমুদ্রের নিচ দিয়ে উড়ে বিসমার্কের অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গানকে ফাঁকি দিয়ে হামলা চালায়। এই আক্রমণে বিসমার্ক এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে সেটি আর সামনে এগোতে পারছিল না, শুধু একই জায়গায় ঘুরতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ৯০ মিনিট ধরে অবিরাম গোলাবর্ষণ করে। অবশেষে, বিসমার্ক ডুবে যায়। ধারণা করা হয়, ব্রিটিশদের হাতে যাতে কোনো তথ্য না যায়, সেজন্য বিসমার্কের নাবিকরাই ভেতর থেকে এটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ডুবিয়ে দিয়েছিল। বিসমার্কের ২,২২১ জন ক্রুর মধ্যে মাত্র ১১০ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। আজও আটলান্টিক মহাসাগরের ১৫,৭১৯ ফুট গভীরে বিসমার্কের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যা ১৯৮৯ সালের ৮ জুন রবার্ট ব্যালার্ড আবিষ্কার করেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *