হৃদরোগের ‘ম্যাজিক’ সমাধান: ওষুধ ছাড়াই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞ

হৃদরোগ আজকাল আর শুধু বয়স্কদের সমস্যা নয়, বরং তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও এর প্রকোপ বাড়ছে। এর পেছনে প্রধান অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL), যা ধমনীতে জমে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। তবে, বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আদ্রিয়ানা কুইনোনেস-কামাচোর মতে, ওষুধের ওপর ভরসা করার আগে জীবনযাত্রায় কিছু সহজ পরিবর্তন আনলেই এই সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তিনি এমন কিছু পরামর্শ দিয়েছেন, যা অনুসরণ করলে শিরা থেকে খারাপ কোলেস্টেরল দূর হতে পারে—ওষুধের প্রয়োজন ছাড়াই।
কোলেস্টেরল: নীরব ঘাতক
খারাপ কোলেস্টেরল যখন ধমনীতে জমে, তখন এটি একটি আঠালো প্লাক তৈরি করে, যা রক্তনালীকে সংকীর্ণ ও শক্ত করে। “এর ফলে হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হয়, যা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে,” জানান ডা. কুইনোনেস-কামাচো। তিনি বলেন, “অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়ামের অভাব, ধূমপান, স্থূলতা এবং জিনগত কারণ এই সমস্যাকে ত্বরান্বিত করে।” তবে, তিনি আশার কথা শোনান, “সঠিক পদক্ষেপ নিলে স্ট্যাটিনের মতো ওষুধের প্রয়োজন কমে যেতে পারে।”
ওষুধের আগে জীবনধারার পরিবর্তন
ডা. কুইনোনেস-কামাচোর মতে, চিকিৎসকরা সাধারণত ওষুধ দেওয়ার আগে জীবনযাত্রার উন্নতির পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনি চারটি মূল পরিবর্তনের ওপর জোর দেন, যা দীর্ঘমেয়াদে হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে পারে। “এগুলো স্ট্যাটিনের চেয়েও বেশি কার্যকর হতে পারে,” তিনি দাবি করেন।
১. স্বাস্থ্যকর চর্বি গ্রহণ: “সব চর্বি খারাপ নয়। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার, যেমন আখরোট, স্যামন, তিসির বীজ বা ম্যাকেরেল, ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায় এবং খারাপ কোলেস্টেরল কমায়,” বলেন তিনি। তবে, স্যাচুরেটেড ও ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি।
২. ফাইবার বাড়ান, চিনি কমান: ফাইবার শরীরে কোলেস্টেরল শোষণ কমায়। “ওটস, গোটা শস্য, ফলমূল, শাকসবজি এবং ডাল আপনার খাদ্যতালিকায় যোগ করুন। একই সঙ্গে চিনিযুক্ত পানীয় ও প্রক্রিয়াজাত খাবার কমিয়ে দিন,” জানান এই বিশেষজ্ঞ। গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ২৫-৩০ গ্রাম ফাইবার গ্রহণে LDL ১০-১৫% পর্যন্ত কমতে পারে।
৩. নিয়মিত ব্যায়াম: “প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা বা যেকোনো শারীরিক কার্যকলাপ হৃৎপিণ্ডকে শক্তিশালী করে এবং LDL কমায়,” বলেন ডা. কুইনোনেস-কামাচো। তিনি যোগ করেন, “ব্যায়াম মানসিক চাপও কমায়, যা কোলেস্টেরল বৃদ্ধির একটি লুকানো কারণ।”
৪. মানসিক চাপ ও ঘুমের ভারসাম্য: “অতিরিক্ত চাপ হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে কোলেস্টেরল বাড়ায়। যোগব্যায়াম বা ধ্যান এটি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে,” তিনি পরামর্শ দেন। এছাড়া, প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, “ঘুমের অভাব ডায়াবেটিস ও রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়, যা কোলেস্টেরলের সঙ্গে জড়িত।”
অতিরিক্ত পরামর্শ: ধূমপান-মদ ত্যাগ
বিশেষজ্ঞরা জানান, ধূমপান ত্যাগ করলে HDL বাড়ে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। একইভাবে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা উচিত। “পেটের চর্বি কমানোও জরুরি, কারণ এটি LDL বৃদ্ধির অন্যতম কারণ,” বলেন ডা. কুইনোনেস-কামাচো।
বাস্তব প্রভাব: গল্প থেকে শিক্ষা
ঢাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম (৪২) গত বছর হৃদরোগের ঝুঁকিতে ছিলেন। তার LDL মাত্রা ছিল ১৬০ মিলিগ্রাম/ডিএল। “ডাক্তার ওষুধ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামে জোর দিয়েছি। ছয় মাসে আমার LDL ১১০-এ নেমেছে,” জানান তিনি। তার খাদ্যতালিকায় এখন ওটস, বাদাম এবং নিয়মিত হাঁটা রয়েছে।
বিশ্লেষণ: ওষুধ ছাড়া কি সম্ভব?
ডা. কুইনোনেস-কামাচোর পরামর্শ কতটা বাস্তবসম্মত? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার কোলেস্টেরলের ক্ষেত্রে জীবনধারার পরিবর্তন যথেষ্ট। তবে, গুরুতর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। “এটি সবার জন্য এক নয়। আপনার শরীরের অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে,” সতর্ক করেন তিনি।